| ফুয়াদ আল আবীর |
গণিত মানেই সৌন্দর্য। গণিতের সৌন্দর্যকে বই-খাতার ভেতর ধামা-চাপা দেওয়া আর মনের গভীর থেকে অনুভব করা, এই দুইয়ের মাঝে যোজন যোজন ব্যাবধান বিদ্যমান। আজ আমরা আমাদের চিরাচরিত অবস্থা থেকে একটু বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। ‘গণিত’ এই শব্দটা শুনলে প্রথমে যে দুটো জিনিস আমার মাথায় আসে তা হল ফিবোনাচি ধারা আর পাই (π) । আমার পৃথিবীতে সবচেয়ে আদরের ধ্রুব হল পাই (π=৩.১৪১৫৯….) আর ধারাটি হল ফিবোনাচি ধারা। এই উপাখ্যানটি মূলত ফিবোনাচি ধারাকে নিয়ে; এখানে আমরা এই ধারার আবিষ্কার ও আবিষ্কারক, এর কিছু বৈশিষ্ট্য, তৈরীর উপায় এবং কিছু রহস্যময়তা সম্পর্কে একে একে জানবো।
এই ধারাটি আবিষ্কার করেন ইতালীয় গণিতবিদ ফিবোনাচি (জন্ম-মৃত্যু: ১১৭০-১২৪০ খ্রীস্টাব্দ) । বিখ্যাত নগরী পিসায় তার জন্ম। তিনিই প্রথম তার বিখ্যাত বই Liber Abaci তে (১২০২ সালে) এই ধারার কথা উল্লেখ করেন এবং আবিষ্কারক হিসেবে এই ধারার নাম তার নামানুসারে করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১২০২ সালেরও বহু পূর্ব থেকেই এই ধারা লুকানো ছিলো আমাদের এই ভারতবর্ষে। অতিপ্রাচীন কালে রচিত বিভিন্ন সংস্কৃত শ্লোকে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ফিবোনাচি সাহেব শুধুমাত্র তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন এবং এর কিছু বিস্ময়কর অবস্থানের কথা বলে গেছেন।
ফিবোনাচি কিভাবে তৈরী করেছিলেন এই ধারা? আসলে ফিবোনাচি ধারা এত সহজেই তেরী করা যায় যে, ক্লাস ওয়ানের যেকোন শিক্ষার্থীও পারবে এই ধারা তৈরী করতে! এর জন্য যেটুকু জ্ঞান লাগবে তা হল, শুধু যোগ করতে পারা । তাহলে কিভাবে তৈরী করা যায়, দেখা যাক। ফিবোনাচি সাহেব বলেছিলেন, ‘এই ধারার প্রথম দুটো পদ হবে ০ আর ১ এবং পরবর্তী পদগুলো হবে, পূর্ববর্তী দুইটি পদের যোগফল।’ অর্থাৎ, প্রথম পদ ও দ্বিতীয় পদ হবে ০ এবং ১, তৃতীয় পদ হবে, প্রথম পদ + দ্বিতীয় পদ= ০+১ =১। চতুর্থ পদ হবে, দ্বিতীয় পদ + তৃতীয় পদ= ১+১ =২। পঞ্চম পদ হবে, তৃতীয় পদ + চতুর্থ পদ = ১+২ =৩ … … এভাবে চলতে থাকবে। আরো কিছু পদ এভাবে যোগ করে করে আমরা যে ধারাটি পাবো তার বিস্তৃত রূপ: ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯, ১৪৪, ২৩৩, ৩৭৭, ৬১০, ৯৮৭, ১৫৯৭, ২৫৮৪, ৪১৮১, ৬৭৬৫, ১০৯৪৬ … … হুম, ধারাটি কিছুটা ইচড়ে পাকা স্বভাবের। ছোট বাচ্চার মত ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হাটি হাটি করতে করতে হঠাৎ করেই যেন দানবাকৃতি ধারন করলো! আসলে এখানেই ফিবোনাচি ধারার আসল সৌন্দর্য নিহিত।
এবার আসল কথায় আসা যাক । আমি এই ধারাটিকে অত্যন্ত রহস্যময়, বলেছি। আমি এ-ও বলছি যে, খুব বেশি থ্রিলিং একটা বিষয় আছে এই ফিবোনাচি ধারায়; যারা মাসুদ রানা বা তিন গোয়েন্দা পড়ে, তাদের হয়তো আর থ্রিলিং-এর খোঁজ করা লাগবে না বইয়ের ভাজে, সব রহস্য যেন ভর করেছে এই গণিতিক ধারায়! অনেকেই ভাবতে পারে, কয়েকটি সংখ্যার যোগে কিই-বা আহামরি বিস্ময় থাকতে পারে? যৌক্তিক প্রশ্ন। আমি যেহেতু এত বড় বড় কথা ইতিমধ্যে বলে ফেলেছি, তাই আমি আমার কথাগুলোর কইফিয়াত দিতে বাধ্য।
থ্রিলিং-এর খোঁজে প্রথমে আমরা চলে যাব গতিদানব(!) শামুকের কাছে। দেখা যাক আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারে কিনা শামুক বাবাজি। শামুক, এই শব্দটা মাথায় আসলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে শামুকের শক্ত খোলস আর পিচ্ছিল একটা দেহ, মাথায় দুটো শুড়ের মত। আমরা এইবার শমুকের একটা ফাঁকা খোলসের দিকে একটু লক্ষ্য করি (চিত্র: ১)। কি দেখতে পাচ্ছি? দেখা যাচ্ছে যে, ভেতরের একটা বিন্দু থেকে খোলসের স্পাইরালটি উপবৃত্তাকার পথে ঘুরে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। এবার আমরা আজকের নায়ক ফিবোনাচি ধারাকে একটু সাজিয়ে নিবো জ্যামিতিক আকারে। প্রথম পদ ০ কে একটি বিন্দু বিবেচনা করে, ধারার প্রতিটি পদের জন্য আমরা এমন একটি করে বর্গ কল্পনা করবো যার প্রতিটি বাহুর মান হবে পদের মানের সমান। অর্থাৎ, দুইটি ১ এর জন্য দুইটি ১X১ বর্গ, ২ এর জন্য ২X২ বর্গ, ৩ এবং ৫ এর জন্য যথাক্রমে ৩X৩ এবং ৫X৫ বর্গ … … এভাবে সব বর্গগুলোকে একত্রে সাজালে আমরা নিচের ছবির (চিত্র ২) ন্যায় একটা আয়ত পাবো। এবার প্রতিটি বর্গের যেকোনো দুইটি বিপরীত কৌণিক বিন্দুকে স্পর্শ করে আমরা যদি কার্ভ বা স্পাইরাল আঁকি তবে তা দেখতে ছবির স্পাইরালের মতই হবে। এখন এই স্পাইরালের সাথে কি কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে শামুকের খোলসের? সবার সুবিধার জন্য দুইটি ছবি পাশাপাশি দেওয়া হল।
আমরা বোধহয় ছবি দুটি থেকে বুঝে ফেলেছি, শামুকের খোলসের স্পাইরাল আর ফিবোনাচি স্পাইরাল হু-বহু এক! একটু অপেক্ষা করুণ, চমক আরো আসছে।
আমার অনেক পছন্দের একটা প্রাণী খরগোশ। একসময় একজোড়া খরগোশ ছানা ছিলো আমার। যদিও তখন জানতাম না যে, খরগোশ মহাশয় পাক্কা গণিতবিদ! জানলে হয়তো আলাদা কদর করতাম! গণিতবিদ খরগোশ তার বংশবৃদ্ধি করে সম্পূর্ণ গণিত মেনে। আগেই বলে রাখি, খরগোশ তার জন্মের দ্বিতীয় মাস থেকে বংশবৃদ্ধি শুরু করে এবং জোড়ায় জোড়ায় বাচ্চা দেয়। আমরা যদি এক জোড়া খরগোশকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে বড় করে তুলি, তবে তারা জন্মের পর দ্বিতীয় মাস থেকে ছানা উৎপাদন শুরু করবে। তাই প্রথম মাসে কোনো বংশবৃদ্ধি হবে না কিন্তু দ্বিতীয় মাসে খরগোশের জোড়া সংখ্যা হবে দুই। এভাবে তৃতীয়, চতুর্খ ও পঞ্চম মাসে খরগোশ জোড়ার সংখ্যা হবে ৩, ৫ ও ৮ এবং পরবর্তী মাসগুলোতে ১৩, ২১, ৩৪ এভাবে। সাধারণত এক বছরে খরগোশ মারা যায় না। তাই বছর শেষে দেখা যাবে, খরগোশ জোড়ার সংখ্যা ১৪৪। এখানের সব সংখ্যাগুলো হচ্ছে ধারাটির পর্যায়ক্রমিক পদ। তাই আমরা বলতেই পারি যে, সবই হচ্ছে ফিবোনাচি ধারা মেনে!
এবার আমরা চলে যাবো আফ্রিকার একটি বনে। বিশাল কোনো এক পাহাড়চূড়ায় খুব ক্ষুধার্ত একটা চিল বসে আছে, পেটের জ্বালা মেটানোর জন্য শিকার খুঁজছে। আমরা এতক্ষণ যতগুলো খরগোশ দেখলাম তার থেকে একটা না হয় বেচারাকে খেতে দেওয়া যেতে পারে। তাই আমরা যদি একটা খরগোশ ছেড়ে দিয়ে আসি তবে কি সে পাহাড়চূড়া থেকে সোজা নেমে এসে শিকার ধরবে? উত্তর- না। কারণ সে তার নিজের শারীরিক গঠন সম্পর্কে অবগত। চিলের দুই চোখের মাঝের বিস্তৃতি এবং প্রতিটি চোখে একটি গভীর ও একটি অগভীর ফোবিয়াস সেন্ট্রালিস থাকে বলে সে সোজাসুজি চলতে পারে না। সোজাসুজি চলতে গেলে সে দিক হরিয়ে ফেলে। তাই সে তার ঠোঁট সোজা রেখে প্রায় ৪০° কোণে বেঁকে ঘুরে ঘুরে নামতে থাকে। আর চিল এইভাবে যে পথে শিকার করে, একটু খেয়াল করলেই দেখবো তা আসলে ফিবোনাচি স্পাইরাল ছাড়া আর কিছুই না (চিত্র: ৩) ।
ফিবোনাচি ধারা যে কিভাবে আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে তা সত্যিই কল্পনাতীত। খরগোশের মত মৌমাছিও তার বংশবিস্তার করে এই ধারা অনুসারে। আবার বিভিন্ন বৃক্ষ শাখা-প্রশাখার বিস্তার করে ফিবোনাচি সংখ্যা অনুযায়ী। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা থেকে সুবিশাল গ্যালাক্সি তথা ছায়াপথের গঠনও ফিবোনাচি ধারা অনুযায়ী (চিত্র ৪.৩)। এছাড়াও আছে এমন অসংখ্য উদাহরণ। সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ির বিন্যাস, কিছু অ্যালোভেরার বিন্যাস (চিত্র ৪.১), বাতাসের নিম্নচাপে সৃষ্টি হওয়া মেঘের বিন্যাস (চিত্র ৪.২), আনারসের খোসার বিন্যাস, ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদের ফ্রন্ডের বিন্যাস (চিত্র ৪.৫), পাইনকর্নের বিন্যাস-সহ (চিত্র ৪.৪) আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে এমন হাজারো দৃষ্টান্ত যেখানে লুকায়িত আছে এই ধারা। এছাড়া বিজ্ঞান এবং গণিতের মাঝে অত্যন্ত ব্যাপক ভাবে মিশে আছে এই ধারা, যার অন্যতম দৃষ্টান্ত প্যাসকেলের ত্রিভুজে ফিবোনাচি ধারার উপস্থিতি।
আজ যে ঘটনা দিয়ে ইতি টানবো, সেটি আমার মনে হয় এই ধারার সবচেয়ে বিস্ময়কর উপস্থিতি। প্রতি বছর যখন ইউরোপের দেশগুলোতে তুষারপাত শুরু হয়, তখন শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য অসংখ্য পাখি আমাদের দেশসহ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। আমরা এসব পাখিকে বলি ‘অতিথি পাখি’। বিজ্ঞানের ভাষায় এদের বলা হয় ‘পরিযায়ী পাখি’। এরা দল বেঁধে এদেশে আসে এবং দল বেঁধেই ফিরে যায়। আশ্চর্য বিষয় হল, প্রতিটি দলের সদস্য সংখ্যা হয় ফিবোনাচি ধারার কোনো না কোনো পদের সমান! অর্থাৎ, এদের দলে ৩৪ বা ৫৫ বা ৮৯ অথবা ১৪৪ টি পাখি থাকতে পারে, কিন্ত কখনও তার ১-২ বেশি বা কম না। দলের সদস্য সংখ্যা এমন হতেই পারবে না, যে সংখ্যার স্থান ফিবোনাচি ধারায় নেই। আবার যখন কোনো একটি বা একাধিক পাখি কোন কারণে মারা পড়ে বা হারিয়ে যায় তখন অন্যান্য পাখিগুলো আবার নতুনভাবে বিন্যস্ত হয় এবং ছোট ছোট দল গঠন করে। এতে করে যে নতুন একাধিক দল তৈরী হয়, সেখানেও তাদের সদস্য সংখ্যা হয় ফিবোনাচি ধারার কোনো না কোনো পদের সমান!
প্রশ্ন আসাটা খুবই স্বাভাবিক যে, খরগোশ, চিল, মৌমাছি, অতিথি পাখিরা এতো সূক্ষভাবে গণিত জানলো কিভাবে? কিভাবে প্রকৃতিতে পদে পদে আমরা গণিতের ছোঁয়া পাই? এতো সবকিছু শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আ’লামীনের করুণায়, যিনি এই বিশ্ব-ব্রম্ভাণ্ডেকে গেঁথেছেন গাণিতের সুতোঁয়। নিউটন-আইনিস্টাইনরা পৃথিবীকে কয়েকটি সূত্রে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন সব কিছু। তারা তাদের কাজে সফলতা দেখিয়েছেন, পৌছেছেন পৃথিবীর্ শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী মানুষদের কাতারে। তারা তা করতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র প্রকৃতির ভাষা বুঝতে পেরেছিলেন বলে। মহান রাব্বুল আ’লামীন আমাদের সামনেই সেই সুযোগ তৈরী করে রেখেছেন, আর আমরা এতোটাই মূর্খ যে কিছুই দেখতে পাই না।
আমরা বাস করছি গণিতের এক বিশাল সমুদ্রে। আমাদের ব্যার্থতা এই যে, আমরা এই অমীয় সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারি না। আমাদের পুরো বিশ্বজগৎ-ই চলছে গাণিতিক নিয়মে। সৃষ্টিকর্তা নিঁখুতভাবে গণিত কষেই তৈরি করেছেন এই মহাবিশ্ব! তাই তো আমাদের এই প্রকৃতি এতো সুন্দর, এতো নিঁখুত।
ফিবোনাচি ধারার আবিষ্কারক লিওনার্দো ফিবোনাচি ধারাটি আবিষ্কারের পর খুব বেশি কাজ করে যেতে পারেন নি। তিনি মারা যাবার আগে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি যদি আর তিনটা বছর বাঁচতে পারতাম!’ শুধুমাত্র এই ধারা নিয়ে কাজ করতে পারার জন্য তার এই আঁকুতি। তিনি না পারলেও আমরা কিন্তু ঠিকই পারি এই রহস্যময় ধারা নিয়ে কাজ করতে। সবার জীবন ফিবোনাচি ধারার মত বৈচিত্রময় হয়ে উঠুক এই শুভকামনা।
No Comment