| তানজীমা সিদ্দীকা |
এক.
– জিরো নাইন জিরো ফোর ওয়ান ফিফটি টু!
– জিরো নাইন জিরো ফোর ওয়ান ফিফটি টু!
– ইয়েস ম্যাম!
আবার রোলকলের সময় ঝিমুনী এসে গিয়েছিলো প্রিয়াঙ্কার। ৬৫ জনের মধ্যে শেষের দিকে রোল হওয়ায় প্রায়ই এমন হয়, টিচার তার রোল পর্যন্ত আসতে আসতে ঝিমুনী চলে আসে। অন্যদিন তো দুই বান্ধবী ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয় তার রোল আসার আগেই। আজ কি হলো? আরেকটু হলেই তো অ্যাটেনডেন্সটাই মিস হয়ে যাচ্ছিলো। প্রশ্ন করার জন্য ডানদিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তনিমাকে পেলো না প্রিয়াঙ্কা। বোকার মত বামদিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। স্মৃতিও নেই। এরপর সামনে পিছনে। কোথাও কেউ নেই। একটা বেঞ্চে বসে আছে সে, সামনে একটা টেবিল। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। শুধু কুয়াশার মত সাদা ধোঁয়া, যত দূর চোখ যায় ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে।
হতভম্ব ভাবটা কাটতে না কাটতেই নারী কন্ঠের আওয়াজে চমকে উঠলো সে।
– প্রি 0904152, please concentrate on the lecture.
এদিক ওদিক কন্ঠস্বরের উৎস খুঁজছে তখন প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না, অন্ধ হয়ে গেলো নাকি? অন্য কোন আওয়াজও তো শোনা যাচ্ছে না, ক্লাশের আর বাকি সব কোথায়? আর এই মহিলাই বা কে? চেনা কেউ বলে তো মনে হচ্ছে না। যদিও ইংলিশেই কথা বলছে, কিন্তু কেমন অদ্ভুত উচ্চারন। তার নামও তো এমন উদ্ভট ভাবে কেউ ডাকে না।
আচ্ছা, এটা স্বপ্ন না তো? কিন্তু স্বপ্ন তো এতো জীবন্ত হয় না। আর কোন উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে বসলো,
– Excuse me! Who are you?
মুহূর্ত পরেই উত্তর এলো,
– I am Namira, your phy-chem professor.
এ কি গ্যাড়াকল? Phy-chem আবার কোন বিষয়?
– কিন্তু আমি তো আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না। অস্থির হয়ে বাংলায়ই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো প্রিয়াঙ্কা।
– দেখতে পাচ্ছেন না কারন আমাকে দেখার কোন প্রয়োজন আপনার নেই। জ্ঞান অর্জনের জন্য শুধু ব্যক্তির মস্তিষ্কের প্রয়োজন, দৃষ্টিশক্তি বা অন্য কোন ইন্দ্রিয় নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু আপনি যথারীতি অহেতুক প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করছেন। দয়া করে জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশ করুন।
– পড়ার জন্য কোন না কোন ম্যাটেরিয়াল লাগে প্রফেসর। আমি কি দেখে পড়বো?
কথা বার্তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বললো প্রিয়াঙ্কা। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কে পড়াশোনা করার কথা চিন্তা করে?
– আপনি খুব ভালো করেই জানেন জ্ঞান অর্জনের জন্য মস্তিষ্ক ছাড়া অন্য কোন ম্যাটেরিয়ালের দরকার হয় না।
বলে কি এই মহিলা? মাথা খারাপ নাকি!
– তাহলে কিভাবে পড়বো? মানে জ্ঞান অর্জন করবো আমি?
– আপনি চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিন। আমার সার্ভার থেকে তথ্য আপনার মস্তিষ্কে পৌঁছে যাবে। আপনাকে শুধু পাওয়া তথ্য গুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হবে, চিন্তা করতে হবে।
দুনিয়া এতো এগোলো কবে? স্বপ্নটা তো ভালোই।
– আপনি কি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন? এবার কি আমরা শুরু করতে পারি?
– হ্যাঁ অবশ্যই। তবে তার আগে যদি আপনি কষ্ট করে আজকের তারিখটা আমাকে বলতেন।
– আজকে ৩০১৫ সালের ৯৫ তম দিন।
কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেলো প্রিয়াঙ্কার শিরদাঁড়া দিয়ে। নিজেকেই বুঝ দিলো সে, স্বপ্নে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাই বলে ৩০১৫ সাল! এ অবশ্যই স্বপ্ন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে এ বিষয়ে হাসি ঠাট্টা হচ্ছিলো তাই এই ব্যাপারেই সে স্বপ্ন দেখছে।
– এটা কোন স্বপ্ন না মিস প্রি, আর আপনি সেটা ভালো করেই জানেন।
এই মহিলা কিভাবে তার মনের কথা বুঝতে পারলো?
– আমি আপনার মস্তিষ্ক দিয়ে পার হওয়া প্রতিটা চিন্তাই বুঝতে পারি মিস প্রি, কিন্তু সব গুলোর জবাব দেয়া জরুরী মনে করি না। এবার কি আমরা শুরু করতে পারি?
– প্লিজ প্রফেসর নামিরা, আমরা কি আজকে অন্য কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারি না?
অন্য কোন উপায় না দেখে নামিরার কাছ থেকেই নিজের প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার সিদ্ধান্ত নিলো প্রিয়াঙ্কা। অবশ্যই এটা একটা স্বপ্ন, কিন্তু জেগে উঠার কোন উপায় সে দেখতে পাচ্ছে না আর ৩০১৫ সালের পৃথিবী সম্পর্কে তার আগ্রহ প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে।
– অবশ্যই, আপনি কি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে চান? আমি সেই বিষয়ের প্রফেসরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
– কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, প্লিজ।
– গুড মর্নিং মিস প্রি 0904152, আমি প্রফেসর কুদরত। আপনার কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স প্রফেসর। আপনি আমাকে যে কোন বিষয়ে যে কোন প্রশ্ন করতে পারেন। মুহূর্ত পরেই একটি পুরুষকন্ঠ শোনা গেলো।
পুরুষকন্ঠ আসলো কোথা থেকে? আবার মনের ভুলে চারপাশে তাকিয়ে কন্ঠের উৎস খুঁজলো প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু সেই একই দৃশ্য। সাদা ঘন কুয়াশা, ধীরে ধীরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার মধ্যে একটা সাদা বেঞ্চে বসে আছে সে, কোথাও কেউ নেই। শুধু মাথার ভিতরে কথা বলছে ডঃ কুদরত। ভয়ংকর নিস্তব্ধ পরিবেশ। এতক্ষন শান্ত থাকলেও এখন ক্রমশ আতঙ্কে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে প্রিয়াঙ্কার। গলা পর্যন্ত উঠে আসা চিৎকারটা কোন রকমে থামালো সে। কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা খুব প্রয়োজন।
– ধন্যবাদ প্রফেসর। আপনি কি আমাকে বলতে পারেন আপনি কিভাবে আমার মাথার ভিতরে কথা বলছেন?
– আপনার মস্তিষ্কে বসানো নিউরো মাইক্রোচিপের মাধ্যমে।
– নিউরো মাইক্রোচিপ?
– জন্মের সময়ই আপনার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্থাপন করা হয়েছে এই চিপ। যার মাধ্যমে আমরা আপনার সাথে কথা বলতে পারি।
– আপনার মাথায়ও কি এই চিপ বসানো আছে? আপনি কোথায় আছেন? আমি আপনাকে দেখতে পাই না কেন?
– মিস প্রি, আমি একটি আলফা গোত্রের কম্পিউটার। আমার সিপিইউ এর সাথে আপনার মস্তিষ্কের নিউরো চিপটির যোগাযোগ আছে।
– কম্পিউটার? আপনি, নামিরা সবাই কম্পিউটার? আপনার কথা তো একদম মানুষের মত লাগছে!
– আমাদের মানুষের মত কথা বলার প্রোগ্রাম করা আছে।
ডঃ কুদরতের দেয়া তথ্যের আকস্মিকতায় প্রিয়াঙ্কা হতবিহবল হয়ে পড়লো। তার কি হতাশ হওয়া উচিত না খুশি! এতক্ষন ধরে সে মানুষ ভেবে একটা যন্ত্রের সাথে কথা বলছে আবার অন্যদিকে মানুষের মত এভাবে কথা বলতে পারে এমন কম্পিউটার তো তার যুগে আবিষ্কারই হয় নি। এগুলোতো সে সায়েন্স ফিকশনে পড়েছে।
আবার এ অবস্থাতেও মনে মনে হাসি পেল প্রিয়াঙ্কার। সে নিজেই ভাবছে যে ভবিষ্যতে চলে এসেছে? এ তো শুধুই একটা স্বপ্ন।
– সব বুঝলাম, কিন্তু আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন? এ কোন জায়গা? এত কুয়াশা!
– এটা কোন জায়গা নয় মিস প্রি। এটা আপনার মস্তিষ্কের তৈরি করা ক্লাসরুম। জ্ঞান অর্জনের জন্য আপনি এখানে আসেন।
– কি বলছেন আপনি? আমার মস্তিষ্কের তৈরি করা মানে?
– মিস প্রি, আপনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না কারন আপনি ক্রায়োস্লিপে ঘুমন্ত অবস্থায় আছেন। আর আপনার মস্তিষ্ক এই পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যেন জ্ঞান অর্জনের সময় কোনভাবেই আপনার মনোযোগ বিক্ষিপ্ত না হয়।
– ক্রায়োস্লিপ? ক্রায়োস্লিপ কি জিনিস মিঃ কু? (আমাকে প্রি ডাকছে তাই আমিও কু ডাকলাম)
– তবে আপনি যদি চান আমি আপনাকে উপভোগ্য কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। (প্রিয়াঙ্কার প্রশ্ন যেন ইচ্ছাকরেই এড়িয়ে গেলো হিলি)
পরমুহূর্তেই প্রিয়াঙ্কার চারপাশের দৃশ্য বদলে গেলো। এখন সে একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে। আশেপাশে খালি সবুজ। এতক্ষন সাদা কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থাকা প্রিয়াঙ্কার চোখ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। একই সাথে জুড়িয়ে যাচ্ছিলো কানদুটোও। চরম নিঃশব্দতা থেকে এখন পাখির কোলাহলে। সবুজ ঘাসের উপর নরম রোদের খেলা দেখতে দেখতে ভুলেই যাচ্ছিলো সে কোথায় আছে। এমন সময় কুদরতের কন্ঠ বেজে উঠলো,
– আপনি কি এই পরিবেশ উপভোগ করছেন? নাকি আপনার সমুদ্র বেশি পছন্দ? অথবা পাহাড়?
বলার সাথে সাথেই প্রিয়াঙ্কার চারপাশে দৃশ্য মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাচ্ছিলো। পার্ক থেকে সে পৌঁছে গেলো কোন এক সমুদ্রের পাড়ে। সাদা বালির বুকে এসে আছড়ে পড়ছে বিশাল বিশাল ঢেউ। আবার কিছু বুঝে উঠার আগেই সে দেখলো সে দাঁড়িয়ে আছে এক পাহাড়ের চুড়ায়। বাতাস যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর অনেক অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে সবুজ সমতল।
কিন্তু দম বন্ধ করা এই সৌন্দর্য কোনোটাই আর প্রিয়াঙ্কাকে ছুঁতে পারলো না। কারন যদিও মুখে এসে ঝাপটা মারছিলো বাতাস, সে বুঝতে পারলো এসব কিছুই তার মাথার ভিতরে তৈরি দৃশ্য। কিছুই সত্যি নয়। কোন না কোন ভাবে কুদরত এই দৃশ্যগুলো তার মাথায় তৈরি করছে।
– ডঃ কুদরত! চিৎকার করে উঠলো সে।
– আমি এসব বানোয়াট দৃশ্য দেখতে চাই না।
প্রিয়াঙ্কার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই গায়েব হয়ে গেলো পাহাড় আর ফিরে এলো সাদা কুয়াশা।
– যেমন আপনার ইচ্ছা, মিস প্রি।
– আপনি বললেন আমি ঘুমিয়ে আছি। আমি এই ক্রায়োস্লিপ নামের ঘুম থেকে জাগতে চাই হিলি। আমি দেখতে চাই আমি আসলে কোথায়।
– সেটা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর হবে মিস প্রি।
– আই ডোন্ট কেয়ার। আপনি আমার জাগার ব্যবস্থা করুন।
– যেমন আপনার ইচ্ছা মিস প্রি।
কথা শেষ হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রিয়াঙ্কার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। চোখের পাতা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেলো। আরেকবার অন্ধকারে ডুবে গেলো প্রিয়াঙ্কা।
দুই.
আস্তে আস্তে চোখ খুললো প্রিয়াঙ্কা। যাক, স্বপ্নটা শেষ হলো। কি অদ্ভুত স্বপ্নরে বাবা! রীতিমত এক সায়েন্স ফিকশন গল্প। কিন্তু চারপাশ এত অন্ধকার কেন? এখনো সকাল হয় নি? তাই বলে এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার?
শুধু বেডের পাশে একটা ছোট্ট ল্যাম্প জ্বলছে। ঘুমানোর সময় তো ল্যাম্পটা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলো। খানিকক্ষন চেষ্টা করে অনেক দূরে দুই-তিনটা আলোকবিন্দু দেখতে পেলো। ওগুলো কি? তবে কি সে এখনো স্বপ্নই দেখছে?
ওঠার চেষ্টা করতেই নিজের শরীর খুব দুর্বল লাগলো। হাত পায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। কেমন শুকিয়ে গেছে তার হাত পা, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে যেন অনেকদিন ব্যবহার হয় না। শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন রঙের টিউব আর তার বের হয়ে যুক্ত হয়েছে বিছানার সাথে। এগুলো কি? কোথায় সে?
– আপনি আপনার মডিউলে আছেন মিস প্রি। এই তার আর টিউবগুলোর সাহায্যেই ক্রায়োস্লিপে থাকা অবস্থায় আপনার শরীরের সকল জৈবিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
বিছানার পাশের স্পীকার থেকে ভেসে আসা ডঃ কুদরতের কন্ঠস্বর শুনে এবার আর আর্তচিৎকার ঠেকাতে পারলো না। আপনা থেকেই বের হয়ে এলো প্রিয়াঙ্কার মুখ থেকে। এখন আর কুদরতের আওয়াজ তার মাথার ভিতরে নেই।
কুদরত এখানে এলো কোথা থেকে? তারমানে সে এখনো স্বপ্ন দেখছে?
– ডঃ কুদরত! আমি কোথায়? আমি কি জেগে উঠিনি?
– আপনি আপনার মডিউলে মিস প্রি। আপনি এখন সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় আছেন।
– আমার মডিউল কোথায়? আর ধৈর্য রাখতে পারছে না প্রিয়াঙ্কা।
– আপনার মডিউল এই মুহূর্তে জুবিলিয়ান গ্যালাক্সীর এক্স-১৬৫ নামক নক্ষত্রের সৌরজগতে অবস্থান করছে। দূরে আপনি যে আলোক বিন্দু গুলো দেখতে পাচ্ছেন তাঁর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি এক্স-১৬৫ নক্ষত্র। এর মোট ১৭টি গ্রহ। সবচেয়ে কাছের গ্রহটি ১০ লক্ষ কি.মি. দূরে রয়েছে।
কথা শুনতে শুনতে নিজের চারপাশে পাগলের মত তাকাচ্ছে প্রিয়াঙ্কা। সে একটা দানবীয় বুদবুদের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। স্বচ্ছ কোন পদার্থের তৈরি এই বুদবুদটি তাকে নিয়ে আস্তে আস্তে মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। বুদবুদটির মধ্যে তার বিছানা ছাড়া আর কিছুই নেই, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ লাগানো বেডটি দেখতে অনেকটা হাসপাতালের বেডের মতই।
– আমি এখানে কেন? পৃথিবী কোথায়? আর সব মানুষ কোথায়?
প্রচন্ড আতংকগ্রস্থ প্রিয়াঙ্কা একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে। কারন সে এবার বুঝতে পেরেছে এটা কোন স্বপ্ন নয়। কোনভাবে সময় ১০০০ বছর এগিয়ে এসেছে। আটকা পড়ে গেছে মহাশূন্যে ভেসে বেড়ানো একটা বুদুবুদের মধ্যে। সঙ্গী শুধু একটা মেশিন। আর কি কোনদিন সে কোন মানুষের দেখা পাবে? পৃথিবীকে দেখতে পাবে? এভাবে একা একা নিকশ কালো অন্ধকারে মৃত্যুবরণ করবে সে?
আতঙ্কে পাগলের মত চিৎকার করে উঠলো প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু তার সেই চিৎকার একটা যন্ত্র ছাড়া আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কারন মহাকাশে শব্দকে পরিবহন করার মত কোন মাধ্যম নেই।
তিন.
তনিমা অ্যালার্মের শব্দে ঘুম থেকে উঠে দেখলো প্রিয়াঙ্কা কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। একটু অদ্ভুত ভঙ্গিতে। কিছু করছে না সে, হাত গুটিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
– কিরে? এতো আগে উঠে বসে আছিস?
কোন উত্তর দিলো না প্রিয়াঙ্কা।
– প্রিয়াঙ্কা! জোরে ডাক দিলো তনিমা।
আস্তে আস্তে মাথা ঘোরালো প্রি 300904152. ধীরে ধীরে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করলো। সে জানে এটা মানে হাসি। খুব সাবধানে নতুন শেখা ভাষায় উচ্চারন করলো,
– অনেক ঘুমিয়েছি রে, আর ঘুমাতে ইচ্ছা করলো না।
– কি বলিস? কত রাতে ঘুমাতে গেলাম! আমার তো উঠতেই ইচ্ছা করছে না। আর স্মৃতিকে তো ধাক্কিয়ে উঠাতে হবে।
আবার হাসলো প্রি। বললো না যে, তারা তো ওর মত শতাব্দীর পর শতাব্দী ক্রায়োস্লিপে ঘুমিয়ে কাটায় নি। অনেক কষ্টে একবার সেই ক্রায়োস্লিপ থেকে জাগার পর আর এক মুহূর্ত সে ঘুমিয়ে নষ্ট করে নি। আলফা গোত্রের কম্পিউটারটির মধ্যে পাওয়া সব তথ্য কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত সে নিজেকে ঐ বুদবুদ জেলখানা থেকে মুক্ত করার একটা উপায় বের করে। অবশ্য পৃথকভাবে টাইম ট্রাভেল, স্পেস ট্রাভেল বা সোল রিপ্লেসমেন্ট করতে পারলেও একই সাথে তিনটা কাজ ছিলো প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। এটা করতে তার বেশ ধকল ও সময় গেছে।
প্রিয়াঙ্কা নামের এই মেয়েটাকে খুঁজে বের করা, এক হাজার বছর টাইম ট্রাভেল করে, এতটা স্পেস পাড়ি দিয়ে সোল রিপ্লেসমেন্ট করা তো চাট্টি খানি কথা নয়। মাঝ খানে সে বার বার হতাশ হয়ে পড়তো, তবু পৃথিবী নামক গ্রহের প্রতি তার তীব্র আকর্ষন, মানব জাতির প্রতি ভালোবাসা, মানুষকে রক্ষা করার তীব্র আকাংখা তাকে উদ্যোম যুগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই ২০১৫ সালের একটা মেয়ের দেহে নিজের সত্তাকে সে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। আর প্রিয়াঙ্কা নামের মেয়েটি আটকা পড়েছে ঐ বুদুবুদে রয়ে যাওয়া তার শুকিয়ে যাওয়া দেহে।
মেয়েটার জন্য তার মায়া হয়। কিন্তু ঐ মেয়ের থেকে তার প্রানের মুল্য অনেক বেশি। অনেক বড় পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে সে। পৃথিবীকে একমাত্র সেই বাঁচাতে পারে। রোধ করতে পারে ঘনিয়ে আসা ভয়াবহ বিপদকে। সেই তুলনায় একটা তুচ্ছ মেয়ের জীবন কিছুই না।
তবে স্রষ্টাও বোধ হয় ক্লাইমেক্স পছন্দ করে, প্রিয়াংকা নামের মেয়েটার বিশ্ববিদ্যালয়ে রোল নম্বর 0904152! এই কো ইন্সিডেন্স দেখে এত পরিশ্রমে কাহিল হয়ে যাওয়ার পরেও অবাক হয়েছে পৃ। তার আইডিও 0904152, সম্পূর্নটা হলো 300904152। আর এই মেয়েটার 200904152। 3009 সালে নামিরার কাছে Phy-Chem শেখা শুরু করলে তাকে এই আইডি দেয় সে। এত অদ্ভুত ঘটনাও ঘটে এই মহাবিশ্বে!
তার পরিকল্পনার প্রথম অংশ খুব ভালো ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। এখন তাকে বাকি কাজ গুলোও সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে। যে কোন মূল্যে বাঁচাতে হবে পৃথিবীকে, মানব জাতিকে। এখন থেকেই শক্ত বুনিয়াদ গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে, জ্ঞানের যে বিশাল ভান্ডার সে নিয়ে এসেছে এগুলো ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে হবে, নিজেদের কস্টার্জিত জ্ঞানকে নিজেদের ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে হবে। কত কাজ!
উত্তরকথনঃ
২৬৯৮ সালে পুরোপুরি বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ে পৃথিবী। মানুষের অসচেতনভাবে ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণ ছিলো এর মূল কারন। নিজেদের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে অন্ধ মানুষ না নিজের চারপাশের পরিবর্তন খেয়াল করেছিলো আর না অন্য প্রানীদের পরিবর্তন। যখন মানুষ বুঝতে পারে যে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে ততদিনে আর কিছুই করার ছিলো না। পৃথিবীতে থাকা ১০ বিলিয়ন মানুষ বা অন্য কোন প্রানীকে বাঁচানোর কোন উপায় কেউ বের করতে পারে নি।
মহাশূন্যে অন্য কোথাও বসবাসযোগ্য কোন গ্রহের সন্ধান তখনো পাওয়া যায় নি। তাই মানবজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে বিজ্ঞানীরা বিশেষ কিছু বুদবুদ আকারের মহাকাশযান তৈরি করেন। সদ্য জন্ম নেওয়া পাঁচ হাজার শিশুকে এরকম পাঁচ হাজার বুদবুদ আকারের মহাকাশযানে করে অজানার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সৌরশক্তি চালিত এই মহাকাশযান গুলো সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতিটি যানে খাদ্য ও অক্সিজেনসহ একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য দরকারি সবধরনের জিনিস আগামী ৫০০ বছরের জন্য দিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও প্রতিটি যানে একটি করে আলফা গোত্রের কম্পিউটার দেয়া হয়, যা শিশুটির মাথায় বসানো নিউরো মাইক্রোচিপের মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। মানবজাতির অর্জিত সকল জ্ঞান কম্পিউটারটিতে দিয়ে দেয়া হয়।
আশা ছিল, কোন একদিন কোন একটি মহাকাশযান বসবাসযোগ্য কোন গ্রহে পৌঁছবে এবং মানব জাতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। বিজ্ঞানীরা সবাই জানে যে মহাবিশ্ব একদিন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে, তখন আর কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু তার পূর্ব পর্যন্ত যে কোন ভাবে মহাবিশ্বের যে কোন জায়গাতেই হোক মানব জাতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে, এ ব্যাপারে সব বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছে। অবশ্য এ ব্যাপারে সবাই আগে থেকেই আরো সাবধান হলে হয়তো এমন বিপর্যয়ে পড়তে হতো না।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কোন যান বসবাসযোগ্য কোন গ্রহে পৌঁছলেই নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অন্য মহাকাশযান গুলোতে সংকেত পাঠাবে। যে যানগুলো তাদের রসদ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই এসে পৌঁছতে পারবে, তাদের মাধ্যমে নতুন সূচনা হবে মানব জাতির।
২৬৯০ সালে যানগুলোকে মহাকাশে পাঠানো হয়। তার আট বছর পরে পৃথিবীর বুকে শেষ মানুষটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে । সকল ধরনের প্রানের উৎস নিঃশেষ হয়ে যায় পৃথিবী থেকে। এর ৫০০ বছর পরে অর্থাৎ ৩১৯০ সালে সবগুলো মহাকাশযানের রসদ শেষ হয়ে যাবে। এবং মহাবিশ্বের শেষ ৫০০০ জন মানুষ নিজ নিজ মডিউলে একা একা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। তাদের মধ্যে ৪৯৯৯ জনের জীবন কাটছে ক্রায়োস্লিপে। শুধু একজন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে পৃথিবী আর মানবজাতিকে বাঁচানোর দায়িত্ব।
উত্তরপূর্বকথনঃ
তনিমা আর স্মৃতি কোনাকুনি বিছানাটায় ডেস্কটপের সামনে বসে আছে। পেজেন্টেশনের স্লাইডে ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে তনিমা। ব্যাংকিং এ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে একটা আইডিয়া কন্টেস্টে অংশ নিচ্ছে তিন বন্ধু।
ফাইনাল ইয়ারে এসে এসব প্রতিযোগীতায় নাম দেয়ার কোন ইচ্ছাই প্রিয়াংকার ছিলো না। কোথায় বাসায় বসে আরাম করবে, তা না সারা সপ্তাহ খাটুনির পরে এখন ছুটির দিনেও রাত জেগে প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হচ্ছে। কালকে আবার সকাল বেলা প্রেজেন্টেশন দিতে যেতে হবে। কোন মানে হয়? কিন্তু বাকি দুইজনের যুগপৎ শারীরিক আর মানসিক অত্যাচারে বাধ্য হয়ে তাকে রাজি হতে হয়েছে। এখন তার অবস্থা অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মত আর কি।
আনমনা হয়ে প্রিয়াংকা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে তার রোল নাম্বার। 200904152। দেখতে দেখতেই কিভাবে এই রোল নাম্বারটা নিয়ে চারটা বছর পার করে ফেললো।
রোল নাম্বারকে ছোট করে 0904152 লেখে সে। ২০০৯ সালে সে এই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে বলে শুরুতে 09।
– কি অদ্ভুত ব্যাপার, আজ থেকে এক হাজার বছর পরে আরেকজন স্টুডেন্ট আমার জায়গায় আসবে। যার রোল নাম্বার হবে 300904152, সেটাও ছোট করলে 0904152 হবে। ততদিন পৃথিবী থাকবে নাকি কেয়ামত চলে আসবে কে জানে?
আনমনে বলে উঠল প্রিয়াংকা।
– একবার চিন্তা কর ব্যাপারটা, তখন হয়তো আর এভাবে একটা বিল্ডিং এ সবাই একসাথে ক্লাশ করবে না। যার যার বাসায় বসে অনলাইনে ক্লাশ করবে। আর যানবাহন সব বাতাসে উড়বে যেমন সায়েন্স ফিকশন সিনেমা গুলোতে দেখায়।
তনিমার মন্তব্য শুনে ওর দিকে তাকালো প্রিয়াংকা। তার এমন কল্পনাশক্তি দেখে স্মৃতির মুখেও হাসি। তিন বন্ধু ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষন হাসি মস্করা করলো। কেমন হবে এক হাজার বছর পরের পৃথিবী?
পরদিন সকাল ৮টায় প্রেজেন্টেশন। তাই নিজ নিজ ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লো সবাই।
বেডের পাশের ছোট্ট ল্যাম্পটা বন্ধ করে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল প্রিয়াংকা।
No Comment