| সিয়াম হুসেইনী |
জুলস ভার্নের লেখা পৃথিবী থেকে চাঁদে কিংবা এইচ জি ওয়েলস এর ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডসপড়া হয়নি- বিজ্ঞান মনস্ক এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। উনিশ শতকের শেষভাগে প্রকাশিত এ লেখাগুলো তখনকার সময়ে নিতান্তই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পর্যায়ে পড়ত। বৈজ্ঞানিক বাস্তবতায় প্রথম এ বিষয়ে গবেষনাধর্মী লেখাটি ছিল একজন রাশিয়ান বিজ্ঞানীর, নাম কন্সট্যানটাইন সিয়েল্কোভস্কি। তাঁর লেখায় প্রভাবিত হয়ে আমেরিকা ও জার্মানীর বেশ কজন তরুন বিজ্ঞানী মহাকাশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁদেরই হাত ধরে পরবর্তীতে মানুষ পৃথিবীর অভিকর্ষ বলয়ের বাইরে যেতে সক্ষম হয়, এমনকি মহাকাশে গড়ে উঠে দীর্ঘদিন মানুষ নিয়ে অবস্থান করার মত স্পেস স্টেশন বা মহাকাশ কেন্দ্র।
শুরুর কথা
মহাকাশ গবেষণা কেবলমাত্র মানুষের বৈজ্ঞানিক উন্নতির নিদর্শন ছিল না বরং একজাতির উপর অন্য জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার এক অঘোষিত লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা আর সোভিয়েত-ইউনিয়নের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ (Cold War) শুরু হয় তার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতা। ১৯৫৭ সালে মনুষ্যবিহীন (Unmanned) প্রথম মহাকাশযান স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপন করে সেই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায় বর্তমান রাশিয়া(তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন)। প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশ ভ্রমন করেন ইউরি গ্যাগারিন ১৯৬১ সালে। অখ্যাত এই প্রকৌশলী রাতারাতি সোভিয়েত-ইউনিয়নের জাতীয় বীর-এ পরিণত হলেন। পুরো প্রক্রিয়াটির পেছনে যিনি মূল কারিগর ছিলেন সেই সের্গেই কোলোরেভ জীবদ্দশায় কোন কৃতিত্ব পাননি। ১৯৬৬ সালে কোলারভের মৃত্যুর পর তার নাম প্রথম প্রকাশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কেননা চল্লিশের দশকে কথিত দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কোলোরেভ সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদি হিসবে জেল খেটেছিলেন। প্রকাশের আগ পর্যন্ত বিশ্ব কোলোরেভ নামে কারো কথা জানতো না। সবার কাছে তাঁর পরিচয় ছিল দ্যা ডিজাইনার হিসেবে। এ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের একের পর এক সাফল্যে আমেরিকান সরকার ও জনসাধারন অস্থির হয়ে উঠেছিল। এরই মধ্যে ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ঘোষণা দেন যে আমেরিকা ১৯৭০ এর মধ্যে চাঁদে অবতরণ করবে। দুঃখজনকভাবে এই ঘোষণার দুই বছরের মাথায় রাজনৈতিক কারণে কেনেডি খুন হলেও ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ প্রথম মানুষ হিসেবে নীল আর্মস্ট্রং আর এডুইন অলড্রিন চাঁদের বুকে মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। এই একটি ক্ষেত্রে আমেরিকার চেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পিছিয়ে পড়ে এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চেষ্টা করেও তারা চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন পূরনে ব্যর্থ হয়ে রণে ভঙ্গ দেয়। বলা হয়ে থাকে চন্দ্রাভিযানে আমেরিকার বাজেটের তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বাজেট দশ ভাগের এক ভাগ ছিল আর সেকারণেই দ্যা ডিজাইনার খ্যাত কোলারেভ সোভিয়েত রাশিয়ার চন্দ্র বিজয়ের স্বপ্নকে পরিণতি দিয়ে যেতে পারেননি।
চাঁদে অস্থায়ী,কৃত্রিম উপগ্রহে স্থায়ী…..
এদিকে পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদে পাড়ি জমিয়েই কিন্তু আমারিকা মহাশূন্য জয়ের অভিযান থামিয়ে দেয়নি। তাদের দাবি অনুযায়ী চাঁদে যাবারও আগে থেকেই মহাশুন্যে স্থায়ী আবাস গড়ার পরিকল্পনা তাদের ছিল। এর সত্যতা মেলে যখন ১৯৭৩ এর মে মাসে স্কাইল্যাব নামের একটি বাসোপযোগী কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে নাসা। স্কাইল্যাব ছিল মহাকাশে দীর্ঘদিন আমাদের অবস্থান নিশ্চিত করার প্রারম্ভিক প্রয়াস- এক অর্থে বর্তমানের যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের কথা আমরা জানি তার আগমনী বার্তা। স্কাইল্যাব পাঠানোর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল স্বল্প অভিকর্ষ বলে আমাদের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিয় কর্মকান্ড কিভাবে পরিচালিত হয় তা যাচাই করা। একই সঙ্গে সেই দুর্বল অভিকর্ষ ক্ষেত্রে এমন কোন রোগপ্রতিরোধকারী রাসায়নিক তৈরী করা যায় কিনা যেটা ভূ-পৃষ্ঠে সম্ভব নয় তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা স্কাইল্যাবে ছিল। স্কাইল্যাবে স্থাপিত শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়েই প্রথমবারের মত সূর্যের মধ্যে যে কর্মকাণ্ড চলছে তার অর্থবোধক ছবি ধারণ করা সম্ভব হয়। মহাকাশ জয়ের এই স্বপ্ন-যাত্রা কিন্তু মোটেই নির্বিঘ্নে হয়নি। বরং প্রথম যাত্রাতেই স্কাইল্যাবের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী চারটি সোলার প্যানেল-এর দুইটি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই বলে নভোচারীরা দমে যাননি। উড্ডয়নের দশ দিন পর পৃথিবী থেকে তিনজন নভোচারীর একটি দল মহাশূন্যে ভাসমান মনুষ্যবাহী গবেষণাগারটি মেরামত করে তাকে পুনরায় বাসপযোগী করে তুলেন। এভাবে নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে স্কাইল্যাব অসীম-আকাশে মানুষের আগমন ঘোষনা করেছিল।
এদিকে ১৯৬৬ তে কোলারেভের মৃত্যুর পর সোভিয়েত রাশিয়াও মহাকাশে স্থায়ী আবাস গড়ার মতো উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহন করে। যার ফলশ্রুতিতে এম.আই.আর.(মির) এর উৎপত্তি। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি পৃথিবীর নিচু কক্ষপথে (Low Earth Orbit) ‘মির’ নামের একটি গবেষনাগার কৃত্রিম উপগ্রহ হিসেবে সংস্থাপনের কাজ করে রাশিয়া। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের পূর্বে দীর্ঘতম সময় মহাকাশে একাধারে মানুষ নিয়ে অবস্থানের রেকর্ড কিন্তু ‘মির’ এরই।
নভোচারীর নিত্যদিন….
আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে সবকিছুই চলে ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী। পৃথিবী থেকে বহু দূরে সম্পূর্ণ বিরূপ পরিবেশকে যথাসাধ্য আরামদায়ক আর বাসপযোগী রাখতে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে চলে না। কৃত্রিম উপগ্রহটি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩৫৪ কিলোমিটার উপরে প্রতি ঘন্টায় ২৭,৭০০ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এ হিসেবে প্রতি ২৪ ঘন্টায় ১৫ থেকে ১৬ বার এটি পৃথিবীকে আবর্তন করে। অর্থাৎ, আমরা যেমন ২৪ ঘন্টায় একবার সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখি স্পেস স্টেশন থেকে নভচারীরা দৈনিক ১৫ থেকে ১৬ বার সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখেন! তারপরও দৈনন্দিন কাজের জন্য তারা নিজেদের দিনকে ২৪ ঘন্টায় ভাগ করে নেন। সে হিসেবে ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে প্রাতকর্ম, সকালের নাস্তা আর প্রাত্যহিক সমাবেশ, যেমনটা আমরা স্কুলে করে থাকি, শেষে তাদেরকে প্রথমেই শারিরিক কসরত করতে হয়; দুর্বল মহাকর্ষ ক্ষেত্রে আমাদের পেশির সঠিক কার্যক্রমের জন্য এর বিকল্প নেই। কিছুক্ষন শরীরচর্চার পর দিনের কাজ অর্থাৎ বিভিন্ন গবেষণার অগ্রগতি লক্ষ্য করা, স্পেস স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি। মাঝে এক ঘণ্টার জন্য দুপুরের খাবারের বিরতি। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে চলে ঘুম-পূর্ব কার্যক্রম যার মধ্যে রয়েছে রাতের খাবার এবং দিনের কার্যক্রম নিয়ে সান্ধ্য-সমাবেশ। রাত সাড়ে দশটার মধ্যেই ঘুমানোর নিয়ম।
নভোচারীদের ঘুমানোর জায়গায় অবশ্যই পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হয়। অন্যথায় তাদের চারপাশে কার্বন ডাই অক্সাইড জমা হতে থাকবে। কারণ সেই দুর্বল অভিকর্ষ বল।
নভোচারীদের খাবার সরবরাহ করা হয় পৃথিবী থেকে বায়ুনিরোধক প্লাস্টিক ব্যাগে। ধাতব কৌটা বা এ জাতীয় কোন কিছু ব্যবহার করা হয় না। কারণ, ধাতব পদার্থের ওজন বেশি এবং পরিবহন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। মাইক্রোগ্র্যাভিটি বা প্রায়শূন্য অভিকর্ষ বল মহাকাশচারীদের স্বাদ এবং ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তাই পৃথিবী থেকে তাদের জন্য খাবার পাঠানোর সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক মশলা যোগ করা হয়। সাধারণত পৃথিবীর মতই কাঁটাচামচ আর ছুরি দিয়ে স্পেশ স্টেশনে খাবার গ্রহণ করা হয়। তবে লক্ষ্য রাখা হয় যেন কোন খাদ্যকণা ভাসতে ভাসতে সংবেদনশীল যন্ত্রের ক্ষতি করে না বসে। কাটাচামচ আর ছুরি ধাতব ট্রের সাথে চুম্বক দিয়ে আটকানো থাকে যেন সেগুলোও ভাসমান না হয়ে যায়। খাবার গরম করার জন্য সেখানে রয়েছে দুটি মাইক্রোওয়েভ ওভেন। একটি রেফ্রিজারেটর যোগ হয়েছে ২০০৮ সালে। বিভিন্ন ধরনের পানীয় প্লাস্টিকের ব্যাগে ডি-হাইড্রেটেড অর্থাৎ পানি-বিযুক্ত অবস্থায় পাঠানো হয় এবং নভোচারীরা পানি মিশিয়ে পান করে থাকেন।
অত্যাবশ্যকীয়ভাবেই মানুষের অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রয়োজন রয়েছে এবং সেসব প্রয়োজন পূরণ করার উপযুক্ত ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে রয়েছে; তবে বোধগম্যভাবেই সে ব্যবস্থা পৃথিবীর চেয়ে একটু আলাদা। ত্যাগকৃত বর্জ্যকে নির্ধারিত জায়গায় জমা রাখার জন্য শক্তিশালী শোষক যন্ত্র রয়েছে যা আমাদের পরিচিত ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের ন্যায় কাজ করে। কঠিন বর্জ্য পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু তরল বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে ব্যবহারযোগ্য পানি আলাদা করা হয় কেননা মহাকাশে পানির যথাযুক্ত কোন উৎস নেই। একেবারে শুরুর দিকে অর্থাৎ ’৭০ এর দশকে ‘স্কাইল্যাব’-এ গোসল করার ব্যবস্থা ছিল। তখন নভোচারিরা মাসে একবার গোসল করতেন। পরবর্তিতে ’৮০ এর দশকে উন্নত গবেষনা সরঞ্জামাদি পরিবহনকে বাধাহীন করতে এবং আরো কিছু কৌশলগত সমস্যা বিবেচনায় মহাকাশ কেন্দ্রে গোসলের প্রথা বাদ দেয়া হয়। অদ্যাবধি বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত আর্দ্র কাপড়, টিস্যু দিয়েই সেই কৃত্রিম উপগ্রহে অবস্থানরতদের প্রাত্যহিক কাজ সমাধা করতে হয়। সেখানে ব্যবহারের জন্য বিশেষ ধরনের শ্যাম্পু রয়েছে যা ধুয়ে ফেলার প্রয়োজন পড়েনা। এমনকি যে টুথপেস্ট সেখানে ব্যবহার করা হয় তা খাবারযোগ্য।
১৯৯৮ সালে সংস্থাপন শুরু হবার পর থেকে অব্যাহতভাবে স্পেস স্টেশনে মানুষের অবস্থান ও গবেষণা চলছে। মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন সাথে নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে অবিরাম সংগ্রাম করে মানুষ এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যৎ বন্দি রয়েছে বর্তমানের প্রতিকূলতায়। সঠিক জ্ঞান, সদিচ্ছা আর মানবকল্যাণে আত্ননিয়োগের শপথই কেবল সুন্দর আগামীকে অবগুণ্ঠনমুক্ত করতে পারে। কল্পবিজ্ঞানের আকাশ-কুসুম কল্পনাগুলো অনেকাংশেই আজ বাস্তব। এ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। পারস্পরিক সহযোগিতায় প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার শিক্ষা, নতুন কোন ধারণাকে বিনা বিবেচনায় বাতিল না ঘোষণা করার শিক্ষা এবং সর্বোপরি, অজানাকে জানার চিরন্তন অনুপ্রেরনা আমরা পেতে পারি আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেদ্র থেকে।
No Comment