| রামিম বিশ্বাস |
“ক্লাউড কম্পিউটিং”! সেইটা আবার কি জিনিস! একি মেঘের গণনা… তোমাদের অনেকের কাছেই এই টার্মটি অজানা। আবার অনেকে আগে শুনলেও ঠিক বুঝতে পার নি, তাই না?
এক কথায়, এইটা একটা কম্পিউটার রিসোর্স শেয়ারিং সিস্টেম (কম্পিউটারের রিসোর্স হচ্ছে এর র্যাম এবং সিপিউ এর প্রসেসিং ক্ষমতা যা ইন্টেল, কোর এককে প্রকাশ করে), যেখানে তোমার পিসির সাথে যুক্ত থাকবে উচ্চ গতির কোন সুপার কম্পিউটার, আর এই সিস্টেম এর মাধ্যমে তুমি তোমার পিসিতেই পেতে পারবে সুপার কম্পিউটারের সুবিধা(তোমার পিসিই হবে ভার্চুয়াল সুপার কম্পিউটার)।
নব্বইয়ের দশকে অনেকগুল পিসিকে তারের মাধ্যমে সংযুক্ত করে এই সুবিধা লাভের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তারের মাধ্যমে হওয়ায় তা তেমন জনপ্রিয় হয়নি, তবে সেটাই ছিল ক্লাউড কম্পিউটিং এর প্রথম ধাপ। পরবর্তীতে ২০০০ সালে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে জন্ম লাভ করে ক্লাউড এবং ২০০৫-০৬ সাল থেকে শুরু হয় আমাজন ডট কমের (amazon.com) ইলাস্টিক কম্পিউট ক্লাউড বা EC2 ।
এখন তোমাকে একটা প্রশ্ন করি,
তুমি কি আজকে কোনো ক্লাউড ব্যবহার করেছো?
জবাবে যদি “না” বল, তাহলে কিন্তু ভুল হবে। জেনে হোক, কিংবা না জেনে হোক, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রায় সবাই দৈনন্দিন নানা কাজে ক্লাউড প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে। কি ফেসবুক কি ই-মেইল কিংবা অন্য কোনো অনলাইন সার্ভিস, সবই ক্লাউড কম্পিউটিং এর মাধ্যমেই দেয়া হচ্ছে বর্তমান ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
চলো, এবার একটু গভীরে যাই।
বিদঘুটে সংজ্ঞায় যাবার আগে সহজ সরল বাংলায় একটা জবাব দেই, ক্লাউড কম্পিউটিং হলো আর কিছুই না, পুরনো প্রযুক্তিরই নতুন সংস্করণ। অর্থাৎ পুরানো কিছু প্রযুক্তিকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে ক্লাউডে। বর্তমানের অধিকাংশ ক্লাউড আসলে খুব বড় আকারের ডেটা সেন্টার, যেখানে হাজার হাজার সার্ভার র্যাকে সাজানো থাকে। মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন ইত্যাদি সবই হাজার হাজার সার্ভারের ডেটা সেন্টার।
ক্লাউড কম্পিউটিং মানে সার্ভিস বা হার্ডওয়ার ভাড়া নেয়া/আউটসোর্সিং।
তোমারা যে স্কুল-কলেজে পড়াশুনা কর তার আশেপাশে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে এখনো হয়ত টাকা জমা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বই ভাড়া নেয়া যায়।
ক্লাউড কম্পিউটিং এর মূল কনসেপ্টটাও তাই।
ধরো, তুমি তোমার ফেসবুক আইডি তে লগ ইন করবে। ফেসবুক কিন্তু তোমার পিসিতে ইন্সটল দেওয়া নেই। ফেসবুক একটা বিশাল সফটওয়ার যা তোমার-আমার পিসিতে চলবে না, তার জন্য দরকার অনেক উচ্চ গতির সুপার কম্পিউটার, যা ব্যয় বহুল। তুমি শুধু ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই সুপার কম্পিউটারের সাথে তোমার পিসিকে সংযুক্ত করবে যেখানে ফেসবুক ইন্সটল করা আছে।
এইবার আসো ব্যাপারটা একটু বড় আকারে চিন্তা করি। ধরি, একটা কোম্পানির ওয়েবসাইট বানানো হবে, তাতে একটা ব্লগ চলবে। ব্লগের অধিকাংশ ব্লগার ও পাঠক বাংলাদেশের। ফলে বাংলাদেশর সময় সকাল ৯টা হতে রাত ১২টা পর্যন্ত ব্লগে লোকজন থাকবে, তার মধ্যে সন্ধ্যা ৮টা হতে ১১টা পর্যন্ত খুব বেশি লোক থাকবে এবং এতোই বেশি ভিজিটর যে সার্ভারে খুব চাপ পড়ে, লোড কমাতে ৩টা সার্ভার একসাথে চালাতে হয় সে সময়। কিন্তু রাত ১২টা হতে সকাল ৯টা পর্যন্ত লোড একেবারেই কমে যায়। তখন ১টা সার্ভারেই কাজ হয়ে যায়।
তাহলে বুদ্ধি!!
এখানে তাহলে মোট দুইটি অপশন আছে।
(১) ৩টা সার্ভার ভাড়া করতে দিনরাত ২৪ ঘণ্টার জন্য, অথবা
(২) যখন ভিজিটর বেশি, তখন ৩ টি ভাড়া নিতে, যখন ইউজার কম, তখন ১ টি সার্ভার চালু রাখতে হবে।
এইভাবে ভাড়া নিতে পারলে কিন্তু খরচ বেশ কমে যাচ্ছে, যখন দরকার নেই, তখন খামোসা টাকা কেন খরচ করবো ? কাজেই, লাভে লাভ!
অন্যদিকে সার্ভার ভাড়া দেয়া কোম্পানিটিরও সুবিধা আছে। যে সময় ১টা সার্ভার ব্যবহৃত হচ্ছে, সে সময়ে বাকি সার্ভারগুলা অন্য কাউকে ভাড়া দিতে পারছে। তাদের সিস্টেম বসে থাকছেনা অলসভাবে কখনোই। এই যে “এখানে সুলভে সার্ভার ভাড়া দেয়া হয়” , এই আইডিয়াটাই ক্লাউড কম্পিউটিং এর মূলমন্ত্র।
ক্লাউডের সংজ্ঞাঃ
ক্লাউড কোনো নির্দিষ্ট টেকনোলজি নয়, বরং এটা একটা ব্যবসায়িক মডেল। অর্থাৎ ক্লাউড কম্পিউটিং এ বেশ কিছু নতুন পুরানো প্রযুক্তিকে একটি বিশেষভাবে বাজারজাত করা হয় বা ক্রেতার কাছে পৌছে দেয়া হয়। যেসব ক্রেতার অল্প সময়ের জন্য কম্পিউটার দরকার বা তথ্য রাখার জায়গা দরকার, কিন্তু এই অল্প সময়ের জন্য কম্পিউটার কেনার পেছনে অজস্র টাকা খরচের ইচ্ছা নাই, তারা ক্লাউডের মাধ্যমে ক্লাউড সেবাদাতাদের কাছ থেকে কম্পিউটার বা স্টোরেজ স্পেস ভাড়া নেন।
তাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্স্টিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ড্স এন্ড টেস্টিং (NIST) অনুসারে ক্লাউড কম্পিউটিং এর সংজ্ঞা নিম্নরূপ –
ক্লাউড কম্পিউটিং হলো ক্রেতার তথ্য ও নানা এপ্লিকেশনকে কোনো সেবাদাতার সিস্টেমে আউটসোর্স করার এমন একটি মডেল যাতে ৩টি বৈশিষ্ট্য থাকবে –
(১) “যত চাই, ততই পাই” বা রিসোর্স স্কেলেবিলিটি – ছোট হোক, বড় হোক, ক্রেতার সব রকমের চাহিদাই মেটানো হবে, ক্রেতা যতো চাইবে, সেবাদাতা ততোই অধিক পরিমাণে সেবা দিতে পারবে।
(২) “চাহিবা মাত্রই” বা অন-ডিমান্ড সেবা – ক্রেতা যখন চাইবে, তখনই সেবা দিতে পারবে। ক্রেতা তার ইচ্ছা মত যখন খুশি তার চাহিদা বাড়াতে কমাতে পারবে।
(৩) পে-অ্যাজ-ইউ-গো – বাংলায় বলতে গেলে “ফেলো কড়ি, মাখো তেল” পেমেন্ট মডেল। অর্থাৎ ক্রেতাকে আগে থেকে কোনো সার্ভিস রিজার্ভ করতে হবে না। ক্রেতা যা ব্যবহার করবে, তার জন্যই কেবল পয়সা দিবে (জিপির পে পার ইউজ প্যাকেজের মত)।
উপরের সংজ্ঞাটাকে আগের উদাহরণের সাথে মিলিয়ে দেখি।
ক্রেতা হিসাবে তোমার কোনো কাজে ১টা সার্ভার লাগলেও ক্লাউড সার্ভিস দাতা সেটা দিতে পারতে হবে, আবার পরক্ষণেই যদি তোমার চাহিদা বেড়ে ১০০টা সার্ভার লাগে, তাও দিতে পারতে হবে। এখানে কালকে দিবো, পরে আসেন, এরকম কোন কথা চলবেনা। আর তোমার সর্বোচ্চ চাহিদা ১০০টা সার্ভার হলে শুরুতেই কিন্তু ১০০টা সার্ভার রিজার্ভ করে রাখতে হবে না, শুরুতে ১টা লাগলে ১টাই ভাড়া নিবে, যদি পরে বেশি লাগে তখন আরো কয়েকটা নিবে, আবার যদি চাহিদা কমে গেলে তবে অব্যবহৃত সার্ভার ফেরত দিয়ে দেবে। আর পয়সা দেয়ার সময়ে গুণে গুণে ঘণ্টা হিসাবে যে কয়েকটা সার্ভার ভাড়া নিয়েছিলে, কেবল সে কয়েকটারই টাকা দেবে।
উপরের সংজ্ঞা মেনে সার্ভিস বিক্রি করে, এরকম যেকোনো সার্ভিসকেই তাই ক্লাউড বলা চলে। আবার উল্টা ভাবে বলা চলে, বড় একটা ডেটা সেন্টারে অজস্র সার্ভার বসিয়ে রাখলেই সেটা ক্লাউড হয় না, যদি উপরের ৩টি বৈশিষ্ট্যের এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য সেখানে না থাকে।
তাহলে এক বাক্যে ক্লাউডের সংজ্ঞাটা দাঁড়ালো:
কম্পিউটার ও ডেটা স্টোরেজ, সহজে-ক্রেতার সুবিধামতো চাহিবামাত্র এবং ব্যবহার অনুযায়ী ভাড়া দেয়ার সিস্টেমই হলো ক্লাউড কম্পিউটিং।
ও হ্যাঁ, ক্লাউড কম্পিউটিং এর নামে ক্লাউড বা মেঘ এলো কোথা থেকে!! ক্লাউড কম্পিউটিং এর ক্ষেত্রে ক্রেতারা সাধারণত ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্লাউড সার্ভিস প্রোভাইডারের ক্লাউডের সাথে যুক্ত হন। নেটওয়ার্ক ডায়াগ্রাম আঁকার সময়ে ক্রেতা ও সার্ভারের মাঝের ইন্টারনেটের অংশটিকে অনেক আগে থেকেই মেঘের ছবি দিয়ে বোঝানো হতো। সেই থেকেই ক্লাউড কম্পিউটিং কথাটি এসেছে।
আমাদের দেশেও এ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে এবং অনেকে দেশের বাইরে এ নিয়ে গবেষণা করছেন। আগামি দিন গুলতে হয়তবা এই ক্লাউড কম্পিউটিংই বর্তমান পার্সোনাল কম্পিউটারকে প্রতিস্থাপিত করবে।
No Comment