| তাসনীম আহমেদ |
প্রায় তিনশত মিটার উপরে শূন্যে ভাসমান একটি স্থানে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ব্যাপন পড়তে কেমন লাগতে পারে? আর যদি চা খেতে খেতে ডানদিকে দেখতে পাও মেঘ তোমায় ছুঁয়ে দিতে চাইছে, আর বামদিকে অথৈ সমুদ্রের বিশালতা তোমায় হাতছানি দিচ্ছে ! এমনাবস্থায় হঠাৎ ব্যাপন-এর ৩১তম পৃষ্ঠা এসে হাজির! ওকে এখন থেকে চারটি পৃষ্ঠা পড়ে নিলেই জানতে পারবে তুমি যেখানে বসে সেখানের রহস্যটা আসলে কী !!
যদি তোমাকে বলা হয়, এক রাত কোন হোটেলের একটি স্যুটে কাটাতে ২৮ হাজার ডলার মানে প্রায় ২২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করা লাগতে পারে, তুমি কি বিশ্বাস করবে? পাগল! প্রশ্নই আসে না। কিন্তু যদি বলা হয় হোটেলটা সমুদ্রের মাঝে, তাহলে? না, না, সমুদ্রের কোন দ্বীপের মধ্যে নয় বরং একেবারে নিরেট সমুদ্রের পানির মধ্যে কোন হোটেলে। যার ছাদ থেকে লাফ দিলে একেবারে নীল সমুদ্রে গিয়ে পড়বে [কিন্তু খবরদার ভুলেও লাফ দেয়ার চিন্তা করো না, কারণ ৫৬ তলা কোন ভবন থেকে লাফ দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না]? হুম! তাহলে চিন্তা করা যেতে পারে।
আবার যদি বলি তুমি কি মহাশূন্যের মধ্যে কোন রেস্তোরাঁয় বসে জুস খেতে চাও অথবা গল্প করতে চাও? হুম, চাই! কে না চায়? কিন্তু মহাশূন্যে তো কোন হোটেলই নাই, আবার মহাশূন্যে যাওয়াও তো অনেক খরচসাধ্য ব্যাপার, তাহলে? তাহলেও হতাশ হবার কিছু নেই। মানুষ মহাশূন্যে হোটেল না বানালেও শূন্যে কিন্তু ঠিকই বানিয়েছে। ঠিক শূন্যে নয় তবে শূন্যের কাছাকাছি। বলছি একটু পরে।
আচ্ছা ২০০০ সালে শুরুতে তোমার জীবনে উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা আছে কি? মনে হয় না। আসলে ২০০০ সালে তোমাদের অনেকের জন্মই হয়নি বা হলেও অনেক ছোট ছিলে। কিন্তু জানো কি যে দুবাইয়ে ২০০০ সালের প্রথম প্রহর অর্থাৎ ১লা জানুয়ারি কী ঘটেছিল? ঐদিন দুবাইয়ে এমন একটি হোটেল উদ্বোধন করা হয়েছিল যা শুধু দুবাইয়ের ইতিহাসই পরিবর্তন করেনি বরং সারা বিশ্বের স্থাপত্য ও প্রকৌশলবিদ্যার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছিল।
বলছি দুবাইয়ের ‘বুর্জ আল আরব’ হোটেলের কথা যা একেবারে সমুদ্রের পানির মধ্যে অবস্থিত এবং এতে রয়েছে একটি রেস্তোরাঁ যা প্রায় শূন্যের উপর অবস্থিত। বুর্জ বা বুরুজ আরবি শব্দ যার অর্থ হল অট্টালিকা বা টাওয়ার। ‘বুর্জ আল আরব’ মানে হল আরবের অট্টালিকা। সত্যিই এটি পুরো আরবের ভাবমূর্তি উচ্চে তুলে ধরেছে।
দুবাইয়ের ক্রাউন প্রিন্স শেখ মোহাম্মাদ বিন রশিদ আল মাখতুম খুবই শৌখিন মানুষ এবং স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। আর উনার স্বভাব হল উনি তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেন। তিনি খুব ভালো করে জানতেন যে দুবাইয়ের তেল আগামী ২০১৬ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে, যা হবে দুবাইয়ের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। চতুর এবং উচ্চাভিলাষী প্রিন্স তখন বিকল্প কিছুর চিন্তা করলেন যা দুবাইকে বিশ্বের বুকে নতুন করে পরিচিত করেছে। তিনি পর্যটনশিল্পে দুবাইকে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইলেন যা তেলবিহীন দুবাইকে কারো শরণাপণ হওয়া থেকে রক্ষা করবে।
বলা হয়ে থাকে সৃষ্টিকর্তা দুবাইকে তিনটা জিনিস অঢেল পরিমাণে দিয়েছেন- সূর্য, সমুদ্র এবং বালু (মরুভূমি)। মজার ব্যাপার হল এ তিনটা জিনিসই অঢেল সম্পত্তিওয়ালা পশ্চিমা ও অন্যান্য শীতপ্রধান দেশের ভ্রমণপ্রিয় মানুষের খুব পছন্দের। বুদ্ধিমান প্রিন্স তখন এ তিনটা জিনিস কাজে লাগিয়ে এমন একটা স্থাপনা নির্মাণের চিন্তা করলেন যা এর আগে কেউ কল্পনাও করেনি।
ক্রাউন প্রিন্স এমন একটি আবাসিক হোটেল নির্মাণের আদেশ দিলেন যা হবে বিশ্বের সব থেকে অভিজাত, সব থেকে উঁচু এবং মজার ব্যাপার হল তা হবে সমুদ্রের পানির মধ্যে। এবং এটি এতই অভিজাত যে, তৈরির পর থেকে এটিই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর একমাত্র সেভেন স্টার মানের হোটেল [উল্লেখ্য বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ফাইভ স্টার মানের হোটেল পাওয়া যায়]।
প্রিন্সের অভিলাষ পুরণের প্রথম ধাপ ছিল এর আকৃতি ডিজাইন করা। প্রিন্স চেয়েছিলেন এমন এক ইউনিক ডিজাইন যা দুবাইকে সারাবিশ্বে প্রতিনিধিত্ব করবে, যেমন আইফেল টাওয়ার প্যারিসকে এবং অপেরা হাউস সিডনিকে প্রতিনিধিত্ব করে। স্থাপত্যবিদরাও প্রিন্সকে হতাশ করেননি। এজন্য অবশ্য স্থাপত্যবিদদের খুব বেশি দূরে যেতে হয়নি। দুবাইয়ের সৈকতে প্রচুর ছোট ছোট পাল তোলা নৌকা চলাচল করে যা দুবাইয়ের অর্থনীতির অন্যতম প্রতীক। আর এই নৌকার পালের আকৃতিকেই ‘বুর্জ আল আরবে’র আকৃতি হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়।
হোটেলটি নির্মাণের পথে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল সমুদ্রের মাঝে একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করা যার ওপরে হোটেলটি দাঁড়িয়ে থাকবে। দুবাইয়ের পাথর আর বালুর সাহায্যে সমুদ্র ভরাট করে দ্বীপ তৈরি করা হয়। কিন্তু সমস্যা বাধে সমুদ্রের বিশাল ঢেউ নিয়ে। দুবাইয়ের সমুদ্র সাধারণত শান্ত থাকে কিন্তু সামুদ্রিক ঝড়ের সময় এটি প্রচন্ড অশান্ত হয়ে যায়। প্রকৌশলীরা ভয় পাচ্ছিলেন যে ঢেউ এসে না আবার কোন পর্যটককে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারা চাচ্ছিলেন ঢেউ যত বড়ই হোক না কেন তা যেন কোনক্রমেই হোটেলের পাদদেশের উপরিভাগে উঠতে না পারে। এজন্য তারা দ্বীপের চারপাশের সীমানা বিশাল সাইজের কনক্রিটের ফাঁপা (hollow) ব্লক দিয়ে ঢেকে দেয়। এতে বিশাল সাইজের ঢেউ এসে ব্লকে আছড়ে পড়ে এবং ঢেউয়ের শক্তি ব্লকে ছড়িয়ে যায় ফলে ঢেউ আর উপরে উঠতে পারে না।
পরের ধাপ ছিল ফাউন্ডেশন তৈরি করা। এত বিশাল আকারের একটি ভবনের ভার বহন করার জন্য পাদদেশে খুব শক্ত ভিত্তি থাকা জরুরি। কিন্তু দেখা গেল প্রচুর খোঁড়াখুঁড়ি সত্ত্বেও শক্ত কোন বেইজ পাওয়া গেল না। সাধারণত যেসব ভবন অনেক উঁচু কিন্তু প্রস্থে বেশ কম হয় তাদের ক্ষেত্রে পাইল ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হয়। পাইল হল বেশ চিকন কিন্তু লম্বা কনক্রিট কলাম যার কাজ ভবনের ভার/লোড ভূমিতে বা অন্য কোন বেইজে ট্রান্সফার করা। এটি সাধারণত দুভাবে লোড ট্রান্সফার করে। সরাসরি শক্ত কোন বেইজে অথবা স্কিন ফ্রিকশনের [পাইলের সাইডের সাথে মাটি বা বালুর ঘর্ষণের কারনে উৎপন্ন বাধা, এই বাধা গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে] মাধ্যমে। যেহেতু নিচে শক্ত কোন বেইজ পাওয়া যায় নাই তাই স্কিন ফ্রিকশনের মাধ্যমেই এই পুরো হোটেলের লোড ট্রান্সফার করা হয়। আর এতে প্রয়োজন হয় প্রায় ২৫০ টি পাইল যার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিঃমিঃ যা পুরো ভবনের দৈর্ঘ্যরে প্রায় ৩৫ গুণ।
মূল ভবনের জন্য প্রধান হুমকি ছিল সামুদ্রিক বাতাস ও ভূমিকম্প। এতে একদিকে যেমন কম্পনের কারণে আরামে বিঘœ ঘটে অন্যদিকে এই কম্পন ছিল ভবনের স্থায়িত্বের জন্য এক স্থায়ী হুমকিস্বরূপ। কারণ কম্পনের ফলে একপাশে টেনশন [টান/প্রসারণ] ও অন্যপাশে কমপ্রেশন [চাপ/সংকোচন] ঘটে। আর কনক্রিট টেনশন নিতে পারে না। কনক্রিট বেশি টেনশনে ফেটে যায়। সুতরাং প্রচ- সামুদ্রিক ঝড় বা ভূমিকম্পের সময় খুব সহজেই হোটেলটি ভেঙে পড়তে পারে। এজন্য শুধু কনক্রিট দিয়ে না তৈরি করে কনক্রিট-স্টিল কম্পোজিট বিল্ডিং তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কারন স্টিল প্রচুর পরিমাণে টেনশন সহ্য করতে পারে। আর কম্পন দূর করে হোটেলটিকে পুরোপুরি আরামদায়ক করতে খাড়া স্টিল মেম্বারের মধ্যে ভর স্থাপন করা হয় যেগুলো স্বাধীনভাবে এদিক ওদিক দুলে কম্পনকে প্রশমিত করে।
এই হোটেলের অন্যতম আকর্ষণ হল “আল মুনতাহা” নামক প্রায় শূন্যে অবস্থানরত রেস্তোরাঁ। এর খুবই সামান্য অংশ মূল হোটেলের সাথে সংযুক্ত এবং বাকি অংশ শুন্যে ভাসমান যা একদিকে দেবে মেঘে ভরা আকাশ আর অন্যদিকে অথৈ সমদ্র।
‘বুর্জ আল আরবে’র মোট উচ্চতা ৩২১ মিটার (১০৫৩ ফিট) যা আইফেল টাওয়ার থেকেও উঁচু। এটি তৎকালীন বিশ্বের সব থেকে উঁচু এবং বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ উঁচু হোটেল। এটির নির্মাণকাজ শুরু হয় নভেম্বর ১৯৯৪ সালে এবং ক্রাউন প্রিন্স চেয়েছিলেন ২০০০ সালের প্রথম প্রহর হোটেলে এই হোটেলে উদযাপন। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হল তিনি পেরেছিলেন। শত প্রতিকূলতা আর নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও মাত্র পাঁচ বছরে এক অদ্ভুত আর প্রায় অকল্পনীয় দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন বিশ্বের সামনে। এবং তিনি থেমে নেই। একের পর এক অদ্ভুত সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন তিনি। যার অংশবিশেষ হিসেবে সমুদের মাঝে একাধিক নয়নাভিরাম কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে চলেছেন ক্রাউন প্রিন্স।
No Comment