| প্রকৌশলী সাব্বির আহমেদ |

ফল্ট লাইনে তিন ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তিনটি কারণেই ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এই ধরনের ঘটনাকে বিচ্যুতি বলে। তিনটি বিচ্যুতি হল অভিসারী বা এক কেন্দ্রাভিমুখী, রিভার্স বা অপসারী এবং ঘর্ষণ বা স্ট্রাইক স্লিপ বিচ্যুতি। ভূ-অভ্যন্তরের টেকটনিক প্লেটের মাঝে বিচ্যুতি ঘটলে হয় অভিসারী বিচ্যুতি, দুটো প্লেট সঙ্কুচিত হলে ঘটে রিভার্স তথা উল্টো বিচ্যুতি, আর পাশাপাশি সরে গেলে ঘটে স্ট্রাইক স্লিপ তথা ঘর্ষণ বিচ্যুতি।

Untitled-3

ফল্ট লাইন ও পাহাড়

লক্ষ লক্ষ ভূমিকম্পের মধ্যে মাত্র ১% আমরা আমাদের নানান যন্ত্র ও টেকনোলজির মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারি। বেশির ভাগ ভূমিকম্প আমরা টেরই পাই না। এর কারণ কী হতে পারে? এর কারণ হলো মহান সৃষ্টিকর্তার দয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন “আমি পাহাড়গুলোকে গেড়ে দিয়েছি পেরেকের মত” (সূরা নাবা:৭), তিনি আরো বলেন “আর আমরা পৃথিবীতে সৃষ্টি করে দিয়েছি পাহাড় পর্বত, যাতে করে পৃথিবী তাদেরকে নিয়ে এদিক সেদিক ঢলে না পরে” (সূরা আম্বিয়া:৩১)। এছাড়া তিনি আরো বলেন “আর তার (পৃথিবীর) মধ্যে মজবুতভাবে গেড়ে দিয়েছেন পাহাড়-পর্বত” (সূরা আন নাজিয়াত:৩২)। আসলেই তাই। প্রত্যেকটি ফল্ট লাইন অনুসন্ধান করে জানা যায় সবগুলো মূল ফল্ট লাইনের ওপরেই পাহাড়ের অবস্থান রয়েছে।  পাহাড়ের ভিত্তি অনেক গভীরে থাকে বলে ভূমিকম্পের শক্তি এরা শোষণ করতে পারে তাই আমাদের কাছে সব ভূমিকম্প অনুভূত হয় না। ফল্ট লাইনগুলোর ওপরে পাহাড় গেড়ে দেয়ার কারণে পৃথিবী ক্রমাগত  ভূমিকম্পের পরও স্থিতিশীল থাকে।

ভূকম্পন তরঙ্গ

পৃথিবীর অভ্যন্তরে দু’ধরনের তরঙ্গের উৎপত্তি লক্ষ্য করা যায়। এগুলো সিসমিক ওয়েভ নামে পরিচিত। ভূমিকম্পের পর ভূমধ্যস্থ কেন্দ্রে নানান ধরনের গলিত লাভা, গ্যাস বাষ্প ইত্যাদি চলাফেরা করে সিসমিক ওয়েভ দ্বারা। ভূমিকম্পের পর দুটো ওয়েভ উৎপন্ন হয়, সেগুলো হলো ১. প্রাইমারি ওয়েভ (ভূমিকম্পের শুরুতেই যে তরঙ্গ তৈরি হয়) ২. সেকেন্ডারি ওয়েভ (প্রাইমারি ওয়েভ শুরু হওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরেই সেকেন্ডারি ওয়েভ শুরু হয়)। দুটো ওয়েভই ভয়ঙ্কর। প্রাইমারী ওয়েভ সাধারণত জোরালো হয়। সেকেন্ডারি ওয়েভ তুলনামূলক কমশক্তি সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে সেকেন্ডারি ওয়েভের কারণেই পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞ ব্যাপক আকার লাভ করে। যেসব ভূকম্পনের সেকেন্ডারি ওয়েভ শক্তিশালী হয়, সেসব ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়।

P-Waves (প্রাইমারি ওয়েভ)

P-Waves (প্রাইমারি ওয়েভ)

S-Waves (সেকেন্ডারি ওয়েভ)

S-Waves (সেকেন্ডারি ওয়েভ)

বাংলাদেশের ভূমিকম্প

বাংলাদেশের ভূমিকম্প বলতে আসলে বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকার ভূমিকম্পকে বোঝায়। কারণ বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের ভূ-অভ্যন্তরের দুটি ভূচ্যুতির (ফল্টলাইন) প্রভাবে আন্দোলিত হয়। কেননা বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার (মিয়ানমারের) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দু’টি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থান করছে। এখানে আশঙ্কা রয়েছে বড় ধরনের নড়াচড়ার অর্থাৎ বড় ধরনের ভূ-কম্পনের। বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে যথা- বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুন্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকি চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক-ডাওকি চ্যুতি) এবং রাঙ্গামাটির বরকলে রাঙ্গামাটি চ্যুতি এলাকা।

নেপালে কিছুদিন পূর্বে উপমহাদেশের ৬৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পুরো দক্ষিু-পূর্ব এশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভূকম্পন মাপক সংস্থা ইউএসজিএস নেপালের ভূমিকম্পটিকে ৭.৯ রিখটার স্কেলে নির্ধারণ করলেও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এই কম্পনের মাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭.৫। এর আগে ১৯৫০ সালে আসামে ৮.৫ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প হয়েছিল। নেপালের এই ভূমিকম্পের পর ৪ থেকে ৫টি আফটার শক হয় এবং প্রতিটি রিখটার স্কেলে ৬ এর ওপরে ছিল। ভারত ও ইউরেশিয়া প্লেটের বাউন্ডারি বরাবর উৎপত্তি হওয়া এই ভূমিকম্পটি বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি হলে পুরো দেশে বিপর্যয় নেমে আসার আশংকা ছিল। প্রচন্ড শক্তিশালী এই ভূমিকম্পটি আমাদের দেশের ৭৪৫ (ঢাকা থেকে) কিলোমিটার দূরে হওয়ায় যে কম্পন অনুভূত হয়েছে তা যদি সীমান্তের আশপাশে হতো সেটা চিন্তা করে শিউরে উঠছি।

নিকট ইতিহাসে সব থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয় দক্ষিু চিলিতে। ২২ মে, ১৯৬০ সালের এই ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামির জেরে কমপক্ষে ১,৭১৬ জনের মৃত্যু হয়। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ছিল ৯.৫।

এবার এসো আমরা জানার চেষ্টা করি ভূমিকম্পের সময় আমাদের করণীয় কী?

ভূমিকম্পের আগে করণীয়

১. বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে নিরাপদ স্থানগুলো আগে থেকেই চিহ্নিত করে রাখো। যাতে ভূমিকম্পের সময় ভাবতে না হয় কোথায় আশ্রয় নেবে। বাসায় যারা ছোট তাদেরকে ভাল করে বুঝিয়ে দাও।

২. ভঙ্গুর জিনিস সবসময় বন্ধ শেলফে রাখা উচিত।

৩. ভারী মালপত্র শেলফের নিচের দিকে রাখা ভালো।

৪. লিক হওয়া গ্যাস লাইন, বৈদ্যুতিক লাইন মেরামত করে নাও এবং নিয়মিত পরীক্ষা করবে।

৫. মাঝে মাঝে মহড়া দাও যাতে সবাই আয়ত্ত করতে পারে।

৬.  নিজের বাসায় সচেতন করো, সাথে তোমার কমিউনিটিকেও।

ভূমিকম্পের সময় ঘরের ভেতরে থাকলে করণীয়

১. ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সাথে সাথে শক্ত-মজবুত কোন আসবাবপত্রের তথা শক্ত টেবিল খাট প্রভৃতির নিচে ঢুকে যেতে পারো এবং সেটিকে হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো যাতে সরে না যায়। এতে করে ভূমিকম্পের ফলে ঘরের কোন জিনিস মাথার উপর পড়তে পারবে না। মনে রাখবে, আমাদের দেহের মধ্যে মাথা হল সবচেয়ে নমনীয় অঙ্গ, মাথা রক্ষা করার চেষ্টা করবে।

২. আসবাবপত্র না পেলে ঘরের ভেতরের দিকের দেয়ালের নিচে বসে আশ্রয় নিতে পারো। বাইরের দিকের দেয়াল বিপজ্জনক। বিমের নিচে দাঁড়াবে। কারণ- ছাদের কোন অংশ ভাঙ্গলেও বিম এত সহজে ভাঙ্গবে না।

৩. জানালার কাচ, আয়না, আলমারি, দেয়ালে ঝুলানো বস্তু থেকে দূরে থাকবে।

৪. বহুতল ভবনের উপরের দিকে অবস্থান করলে ঘরের ভেতরে থাকাই ভাল। কারণ, নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর পূর্বেই ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।

৫. ভূকম্পন থেমে গেলে বের হয়ে আসবে।

৬. নিচে নামতে চাইলে কোনোভাবেই লিফট ব্যবহার করবে না। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নামবে। নামার সময় মোবাইল ফোন আর ঘরের চাবিটা সম্ভব হলে হাতে নিয়ে নেবে।

৭. বিছানায় শোওয়া অবস্থায় থাকলে বেশি দূরে না গিয়ে খাটের নিচেই আশ্রয় নাও।

ঘরের বাইরে থাকলে করণীয়

১. খোলা জায়গা খুঁজে আশ্রয় নাও।

২. লাইট পোস্ট, বিল্ডিং, গাছ অথবা বৈদ্যুতিক পোলের নিচে দাঁড়াবে না।

৩. রাস্তায় ছোটাছুটি করবে না। মাথার উপর কাচের টুকরা, ল্যাম্পপোস্ট অথবা বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

চলমান গাড়িতে থাকলে করণীয়

১. গাড়ি থামিয়ে খোলা জায়গায় পার্ক করে ভেতরেই আশ্রয় নাও।

২. কখনই ব্রিজ, ফ্লাইওভারের উপরে বা নিচে থামবে না।

৩. ভূমিকম্প না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরেই অপেক্ষা করতে থাকো।

ভূমিকম্পের পরে করণীয়

১. ভূমিকম্প শেষ হলেও আরও একটি-দু’টি মৃদু কম্পনের জন্য প্রস্তুত থাকো। এই আফটার শকের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আবার হতে পারে।

২. যথাসম্ভব শান্ত থাকবার চেষ্টা করবে। কম্পন থেমে গেলেও কিছুক্ষন অপেক্ষা করে তারপর বের হবে।

৩. নিজে আহত হয়েছ কিনা পরীক্ষা করো, অপরকে সাহায্য করো।

৪. বাড়িঘরের ক্ষতি পর্যবেক্ষু করো। নিরাপদ মনে না হলে সবাইকে নিয়ে বের হয়ে যাও।

৪. গ্যাসের সামান্যতম গন্ধ পেলে জানালা খুলে দেবে এবং দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ যে কোন সময় আগুন লাগতে পারে।

৫. কোথাও বৈদ্যুতিক স্পার্ক চোখে পড়লে মেইন ফিউজ বন্ধ করে দেবে।

ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়লে করণীয়

১. আগুন জ্বালাবে না। বাড়িটিতে গ্যাসের লাইন লিক থাকলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

২. হাত অথবা রুমাল দিয়ে নাক মুখ ঢেকে নেবে।

৩. ধীরে নড়াচড়া করবে এবং উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকবে।

৪. উদ্ধার কাজের সময় নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে পাইপ অথবা দেয়ালে টোকা দিয়ে শব্দ করবে। চিৎকার না করাটাই শ্রেয় এতে প্রচুর পরিমাণে ধুলা নিঃশ্বাসের সাথে ঢুকে যেতে পারে। ফলে শ্বাসকষ্ট হয়ে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

উপরের করণীয়গুলো আমরা সবাই মোটামুটি জানি। কিন্তু বিপদের সময় মনে থাকে না। আশা করি আমরা সবাই সচেতন থাকবো এবং বাসার সবাইকে সচেতন রাখবো। সেই সাথে নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করবো।