| মোঃ মাহমুদুন্নবী |
আল্লাহর রহমতে আগের বছর (২০১৩) যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, সে বিষয়টা (earth science বা ভূ-বিজ্ঞান) ছিল আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে অজানা একটা বিষয়। আর এবারের (২০১৪) বিষয় তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানে (Astronomy) অনেক পরিচিত, আকর্ষণীয় ও কৌতূহলদায়ক হলেও এদেশে অনেক অবহেলিত একটি বিষয়। যেখানে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও Astronomy পড়ার কোনরকম সুযোগ নেই, সেখানে অন্যান্য দেশে high school level থেকেই physics, chemistry, biology এর পাশাপাশি astronomy পড়ানো হয়। এই একটা বাক্যই হয়ত আমাদের অবস্থান বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
যাই হোক, ২০০৭ সাল থেকেই Astronomy Olympiad -এর অঙ্গনে বাংলাদেশের পদযাত্রা। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও Bangladesh Astronomical Association এর আয়োজনে আঞ্চলিক ও জাতীয় অলিম্পিয়াডের মাধ্যমে বাছাই করা হয় দেশের প্রতিনিধিদের। রাজশাহী অঞ্চল থেকে ২য় স্থান অধিকার করার পরে জাতীয় পর্যায়ে জুনিয়র গ্রুপে (অনূর্ধ্ব-দশম শ্রেণী) প্রথম স্থান অধিকার করে IOAA বাংলাদেশ দলে চান্স পাই। এমনিতে আমাদের অলিম্পিয়াডগুলোতে ভিসাসংক্রান্ত বেশ কিছু ঝামেলা পোহাতে হয়, তার ওপর আবার এবারের আয়োজক রোমানিয়ার দূতাবাসই এ দেশে নেই।
তবে সব ঝামেলা কাটিয়ে দলনেতাদের সাথে আমাদের ৬ সদস্যের বাংলাদেশ দলের যাত্রা শুরু হয় রোজার ঈদের দুদিন পর। দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টার আকাশভ্রমণের পর রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট পৌঁছা, সেখান থেকে আবার ৭-৮ ঘন্টার পথ পেরিয়ে অবশেষে রোমানিয়ার Stefan Cel Mare University তে এসে ৪২ দেশ থেকে আসা প্রায় ২০০ জন প্রতিযোগীর সাথে মিলিত হওয়া।
১০ দিনের মধ্যে পরীক্ষাই ছিল প্রায় ৪ দিন ব্যাপী। ৩ ঘণ্টা ধরে দুই ধরনের পর্যবেক্ষণ পর্ব বা Observational round (planetarium and sKz chart), ৫ ঘণ্টার Theoretical round আর ৪ ঘণ্টার Data analysis round আমাদের সৌভাগ্যের জন্যই হয়ত সর্বশেষ telescope based round নষ্ট করার জন্য ছুটে আসে আকাশ ভরা মেঘ। আমাদের জন্য মোটামুটি সবচেয়ে কঠিন এ রাউন্ড হয়তো ফলাফল অন্যরকম করে দিতে পারত। কিন্তু আমি এখনো সে কষ্ট ভুলতে পারি না যে, মাঠের মধ্যে ২০-৩০টা টেলিস্কোপ নিয়ে ৩ ঘণ্টা বসে থেকেও মেঘের জন্য সাধের টেলিস্কোপগুলো একটুও কাজে আসলো না। সবশেষে additional রাউন্ড হিসেবে ছিল Team Competition.
অলিম্পিয়াড মানে অবশ্যই শুধু প্রতিযোগিতা নয়। পরীক্ষার সাথে সাথেই তাই চলেছে আমাদের আশপাশের ঐতিহ্যবাহী গির্জা, দর্শনীয় বিভিন্ন স্থান, জাদুঘর, পার্ক, কুমোরশালা, শপিং মল ইত্যাদিতে ভ্রমণ। ফুটবল, টেবিল টেনিস, ভলিবল ইত্যাদি খেলা, ঝুলন্ত ব্রিজ, cable car, কাঠবহনের রেলগাড়ি, নানাবিধ মারাত্মক খাবার-দাবার, কার্বনেটেড পানি, movie night, cultural show থেকে শুরু করে midnight prank বা মৃত্যুর আগের অভিজ্ঞতা (our secret ?)- অভিজ্ঞতার ঝুলি তো কম না! তবে স্বাভাবিকভাবেই সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে বিভিন্ন দেশের সাথে গড়ে ওঠা অকৃত্রিম বন্ধুত্ব, অসাধারণ team guide দের সাথে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, স্মৃতিপটে চির অম্লান হয়ে থাকা স্মৃতিগুলো!
সবশেষ অভিজ্ঞতাটা সত্যিই আমার জন্য চিন্তারও বাইরে ছিল। সে সময়ের অনুভূতি সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করার মতো না, যখন এতগুলো দেশের সামনে নিজ দেশের পতাকা নিয়ে সামনে দাঁড়ানো যায়। মহান ¯্রষ্টার কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোন ভাষা নেই ।
আমাদের দেশে যারাই ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বিষয় থাকে astrophysics এর অন্যতম অংশ- মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিবর্তন বিষয়ক বিদ্যা তথা Cosmology (black holes, creation and destination of universe etc.)
আর রাতের তারাভরা আকাশ সবসময়েই সকলকে আগ্রহী আর কৌতূহলী করে তোলে (যাদের কখনো গ্রামের আকাশ দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তাদের আসলে কোনভাবেই এই আবেগটা বোঝানো যাবে না।) এত সুন্দর তারাগুলো আমাদের থেকে এত এত দূরে অবস্থিত যে প্রত্যেকেই একেকটা টাইম মেশিনের মতো আচরণ করে। ধরা যাক, খুব সাধারণ একটা তারার দূরত্ব আমাদের থেকে ৮০০ আলোকবর্ষ। তার মানে ঐ তারকা থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে ৮০০ বছর সময় লেগে যায়। আমার চোখে এখন তারার যে আলো এসে পৌঁছাচ্ছে, সেটা আসলে এখন থেকে ৮০০ বছর আগে রওনা হওয়া আলোকরশ্মি। দুচোখ ভরে যে তারা দেখছি, সেটা আসলে ৮০০ বছর আগের ঐ তারার অবস্থা। এখন যদি এই দানবাকার অগ্নিগোলক ধ্বংসও হয়ে যায়, তাও আমি আরও ৮০০ বছর সেই তারাকে দেখতে পারব!
এসব কিছু সত্যিকার অর্থেই এদেরকে জানার ইচ্ছাটা অত্যন্ত প্রবল করে তোলে। কিন্তু তারপরও এদেশের প্রায় সব অলিম্পিয়াডের মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্ব পায় Astronomy Olympiad. কেননা এই অনুপ্রেরণা পাওয়ার উৎস আমাদের চারপাশে নেই বললেই চলে। আমাদের স্কুল কলেজের পড়াশোনা আমাদের Astronomy সম্পর্কে অন্তত Math বা Physics এর মতো সামান্যতম কিছুও জানার আগ্রহ জোগায় না। আর নানাবিধ সমস্যায় এর প্রসার প্রচারণাও গধঃয ঙষুসঢ়রধফ এর মতো আহামরি ধরনের না।
তবে এগিয়ে তো আমাদেরই আসতে হবে, তাই না?
প্রতি বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকেই দেশের প্রায় ১০-১২টি স্থানে আঞ্চলিক Astro-olympiad শুরু হয়ে যায়। ৮ম বা তদূর্ধ্ব শ্রেণীর স্কুল কলেজের যেকোন ছাত্রছাত্রী বিনামূল্যে আঞ্চলিক পর্যায়ে অংশ নিতে পারে। রেজিস্ট্রেশন যেমন প্রতিযোগিতার আগেও নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে করা যায়, তেমনি প্রতিযোগিতার স্থলে এসেও করা যায় (spot registration)। এসব ব্যাপারে updated থাকার সবচেয়ে ভাল উপায় Bangladesh Astronoimical Assotiaon (BAA) এর ওয়েবসাইট www.astronomybangla.com আর ফেসবুক গ্রুপের web.facebook.com/groups/mohakash.barta সাথে যোগাযোগ রাখা।
একেবারে প্রাথমিক প্রস্তুতির জন্য বাংলায় খুব ভাল একটা বই ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ও লামমীম আহাদের লেখা “সবার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা”। Astrophysics এর জন্য পাঠ্যবইয়ের physics শেষ করাটা দরকার। Observation এর জন্য আব্দুল জব্বারের “তারা পরিচিতি” পড়া যেতে পারে।
আরো পড়াশোনার জন্য চমৎকার দিকনির্দেশনা, বইপত্র, আগের প্রশ্ন, উত্তর পাওয়ার জন্য ইন্টানেটের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
লেখক : একাদশ শ্রেণী, রাজশাহী কলেজ
Honorable mention
International Olympiad on Astronomy and Astrophysics 2014, Romania
No Comment