| মো.জাহিদ খাঁন |
যে প্রাণীর বসবাস ও খাদ্যাভাসের ধরণ আমাদেরকে শুধু চমকিতই করবে না, করবে আতংকগ্রস্তও। মনে হবে যেন কোন হরর উপন্যাসের একটি ভয়ংকর প্রাণীর কথা আমরা পড়ছি, যা কিনা লুকিয়ে থাকে মাটির ভেতর,আর তাঁর শিকারকে মাটির নিচে টেনে নিয়ে যায় আচমকাই। ধারালো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলে শিকারকে।
জ্বী, এরকম রক্ত পানি করা সব ভয়ংকর কার্যকলাপই করে থাকে এই ববিট ওয়ার্ম।
ববিট ওয়ার্ম (ইড়ননরঃ ডড়ৎস)
“অহহবষরফধ” পর্বের এবং “চড়ষুপযধবঃধ” শ্রেণীর এই প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে “ঊঁহরপব ধঢ়যৎড়ফরঃড়রং” আর পুস্তকই বা প্রচলিত নাম হচ্ছে ববিট ওয়ার্ম। এই ববিট ওয়ার্ম নামকরণ নিয়েও আছে বেদনা মেশানো একটি হাস্যকর ইতিহাস। যা একটু পরই বলছি।
বসবাসের ধরণ ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য
সাগরতলের কাঁকড়, কাদা এবং প্রবালময় মাটিতে এই দীর্ঘকায় পোকাটি মাটি খুঁড়ে গর্ত করে এক প্রকার সমাধিস্থ হয়ে বসবাস করে থাকে।
রক্তাভ, রঙিন বর্ণ এই প্রাণীটিকে শুধু ভয়ংকর খুনেই করে তুলেনি, করে তুলেছে ভয়ংকর সুন্দরও।
ববিট ওয়ার্মের কোন চোখ নেই, এমনকি নেই মস্তিষ্কও। তবে এর দেহের সম্মুখভাগে রয়েছে পাঁচটি আলো ও রাসায়নিক পদার্থ সংবেদী (জবপবঢ়ঃড়ৎং) সম্পন্ন অ্যান্টেনা।
এই অ্যান্টেনাগুলোর মাধ্যমেই সে অপেক্ষায় থাকে তাঁর শিকারের আগমনের।
যে অ্যান্টেনাকে শিকার এসে নিজের অজান্তেই উদ্দীপ্ত করবে ববিট ওয়ার্মের আহার হবার জন্য।
ধারালো দাঁত দ্বারা সজ্জিত এই ববিট ওয়ার্ম অত্যন্ত ক্ষীপ্রতার সাথে তাঁর শিকারকে হামলা করার জন্য প্রসিদ্ধ।
খাঁজকাটা কাঁচি সদৃশ এক জোড়া শক্তিশালী চোয়াল রয়েছে এর, যার দ্বারা শিকারকে সে দ্বিখ-িত করে ফেলে এক নিমিষেই।
ববিট ওয়ার্ম তার শিকারকৃত প্রাণীটির দেহে বিষ প্রবেশ করিয়ে দেয় যা কিনা তার শিকারটিকে অচেতন করে ফেলে অথবা মেরে ফেলে।
আর তার এই দক্ষতার কারণে নিজের দেহের চাইতেও বড় কোন প্রাণীকে সে আক্রমণ করতে পারে এবং ভক্ষণ করে ফেলতে পারে।
খাদ্যাভ্যাস
ববিট ওয়ার্ম একটি সর্বভূক নিশাচর প্রাণী। রাতের অন্ধকারেই এরা শিকার করতে পছন্দ করে।
সমুদ্রতলের বিভীষিকা হতে যত রকমের বিশ্লেষণ দরকার,তার প্রায় সবই এই প্রাণীটির রয়েছে। ক্ষুধার্ত থাকলে অবশ্য এরা দিনের বেলায়ও শিকারে বের হয়।
এর খাদ্য তালিকায় রয়েছে সাগরতলের নানান রকম আবর্জনা, পোকা, শৈবাল ও মাছসহ ক্ষুদ্রাকৃতির শৈবালও।
ফায়ার ওয়ার্মস
এই ঢ়ড়ষুপযধবঃধ শ্রেণীরই আরেকটি হচ্ছে “ঝবধ গরপব” নামে খ্যাত ফায়ারওয়ার্মস (ঋরৎবড়িৎসং). যাদের দেহে রয়েছে অসংখ্য হারপুনাকৃতির অমসৃণ লোম (ইৎরংঃষবং) যা কিনা বিষাক্ত পদার্থ নি:সৃত করে শিকারের ত্বকে মারাত্মক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে।
কিন্তু, ববিট ওয়ার্মের এই লোমগুলো শুধু সাগরতলের ভূমির উপর চলনরত শিকারকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে এবং এর গর্তের ভেতর টেনে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। পাশাপাশি ববিট ওয়ার্মকে হামাগুড়ি দিয়ে চলতেও সাহায্য করে থাকে।
ববিট ওয়ার্মের দৈহিক বৃদ্ধি
ববিট ওয়ার্ম এক মিটার থেকে প্রায় তিন মিটার বা দশফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে।
জাপানের “কঁংযরসড়ঃড় গধৎরহব চধৎশ ঈবহঃৎব” এর সহকারী পরিচালক “ঐরৎড়’ড়সর টপযরফধ”র দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৯ সালে জাপানের “ঝবঃড় ঋরংযরহম ঐধৎনড়ঁৎ” থেকে একটি তিন মিটার লম্বা ববিট ওয়ার্মের খোঁজ পাওয়া যায়।
এই ববিট ওয়ার্মটির ওজন ছিলো ৪৪৩ গ্রাম, যা কি না এ যাবৎ পর্যন্ত পাওয়া সকল ববিট ওয়ার্মগুলোর মধ্যে বৃহৎ ছিলো।
ইন্দো-প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরসহ ববিট ওয়ার্ম পৃথিবীর ক্রান্তীয়-উপক্রান্তীয় অর্থাৎ উষ্ণমন্ডলীয় মহাসাগরগুলোতে পাওয়া যায়।
এই ববিট ওয়ার্মটি দূর্ঘটনাবশত (!) সাগরতল ছাড়াও অন্য কোন মনুষ্যসৃষ্ট জলাধারেও দেখা যেতে পারে।
২০০৯ সালের মার্চে ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথে জনগণের জন্য উন্মুক্ত জলজ প্রাণীর একটি সংগ্রহশালা “ঞযব ইষঁব জববভ অয়ঁধৎরঁস” এর একটি ট্যাংক থেকে ববিট ওয়ার্ম খুঁজে পাওয়া যায়।
সেখানকার এক কর্মী অ্যাকুরিয়ামে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পান যেমন কিছু মাছের আহত হওয়া অথবা অ্যাকুরিয়াম থেকে ¯্রফে হাওয়া হয়ে যাওয়া, আবার অ্যাকুরিয়ামের প্রবালগুলোর টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
পরবর্তীতে অ্যাকুরিয়ামের ট্যাংকটিতে অনুসন্ধান চালালে এ সবকিছুর মূল হোতা ববিট ওয়ার্মটির খোঁজ পাওয়া যায় অবশেষে।
সেখানকার কর্মীরা এর নাম দিয়েছিলেন “ইবৎৎু”.
২০১৩ এর অক্টোবরে, ইংল্যান্ডের আরেকটি জলজ প্রাণী ও পণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠান “গধরফবহযবধফ অয়ঁধঃরপং”এর ট্যাংকে ববিট ওয়ার্মের খোঁজ পাওয়া যায় যেটা লম্বায় ছিলো প্রায় সাড়ে তিনফুট।
নামকরণের ইতিহাস
আগেই বলেছিলাম, ববিট ওয়ার্মের নামকরণ নিয়ে আছে একটি করুণ ও হাস্যকর ইতিহাস। এবার তা খোলাসা করে বলছি। “ববিট ওয়ার্ম” নামটি বাছাই করা হয় ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত “ঈড়ৎধষ জববভ অহরসধষং ড়ভ ঃযব ওহফড়-চধপরভরপ” নামক একটি বই থেকে। এই বইটির লেখকগণ হচ্ছেন উৎ. ঞবৎৎু এড়ংষরহবৎ, উধারফ ইবযৎবহং ও এধৎৎু ডরষষরধসং.
মূলত নামটি বাছাই করেন এই তিনজন লেখকের একজন উৎ. ঞবৎৎু এড়ংষরহবৎ.
এখানে এটা উল্লেখ থাকে যে “ইড়ননরঃ” হচ্ছে একটি বংশ পদবী।
১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে খড়ৎবহধ ইড়ননরঃ নামক এক মহিলা ধারালো ছুড়ি দিয়ে ওনার ঘুমন্ত স্বামীর দেহের স্পর্শকাতর অঙ্গে আক্রমণ করেন। আর এই হিং¯্র কর্মকা-টি তখনকার সংবাদ মাধ্যমগুলোর হেডলাইনে পরিণত হয়েছিলো।
মহিলাটির এই নিষ্ঠুর কর্মকা- আর ববিট ওয়ার্মের তাঁর শিকার করা প্রাণীকে নিমিষেই দ্বি-খ-িত করে ফেলার মধ্যেই যেন ভয়ংকর একটি মিল দেখতে পেয়েছিলেন ঞবৎৎু এড়ংষরহবৎ.
তাই হয়তো তিনি প্রাণীটির নামকরণের ক্ষেত্রে সেই নিষ্ঠুর মহিলাটির নামের সাথে যুক্ত বংশ পদবীটি বেছে নিয়েছিলেন।
ববিট ওয়ার্মের মতোই আরও কত রকমের রহস্যময়, হিং¯্র এবং ভয়াল দর্শণ প্রাণী যে সাগরগর্ভে আজও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে তা আমাদের জানা নেই। রহস্যে ঘেরা সমুদ্রের সকল রহস্যকে উন্মোচন করাটা হয়ত কখনোই সম্ভব নয়, তবে, মানবজাতির অনুসন্ধানী চোখ প্রতিনিয়তই অবিরাম অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রতলে, আর উন্মোচিত করছে অদ্ভুতুড়ে সাগরতল, চমকিত করছে আমাদের সকলকে।
No Comment