।ডাঃ মোঃ ফজলুল কবির পাভেল।
লাল মাংস এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার
প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে দেখা গেছে প্রায় ৩০ হাজারের মতো রোগীর মৃত্যু ঘটে। প্রোস্টেট গ্রন্থি শুধু ছেলেদেরই থাকে। বয়সের সাথে সাথে প্রোস্টেট গ্রন্থিও বৃদ্ধি পায়। প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হওয়া মানেই যে আবার ক্যান্সার তা কিন্তু নয়।
বর্তমানে প্রোস্টেট ক্যান্সার সফলভাবে চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে এর জন্য দরকার সচেতনতা।
চিত্র-১: মানবদেহের প্রোস্টেট গ্রন্থি
প্রোস্টেট ক্যান্সার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। তাই কয়েক বছর পর্যন্ত সব লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তবে প্রোস্টেট বড় হয়ে যখন মূত্রনালীকে আক্রান্ত করে তখনই কিছু লক্ষণ দেখা যায়। রোগী তখন প্রস্রাব করতে বেশ কিছু অসুবিধাবোধ করে।
বিভিন্ন রকম সমস্যা হতে পারে। সবার যে আবার একই রকম সমস্যা হয় তা নয়। একেকজনের একেক রকম সমস্যা বেশি হয়। যেসব উপসর্গ দেখা যায় তার মধ্যে আছে –
১। হঠাৎ বেশি বেগে প্রস্রাব হওয়া।
২। প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া।
৩। প্রস্রাবের সময় ব্যথা অনুভব হওয়া।
৪। বীর্যের সাথে রক্ত যাওয়া।
৫। কোমর ও তলপেটে ব্যথা অনুভব করা।
৫। রাতের বেলা বেশি বেশি প্রস্রাব হওয়া।
৬। প্রস্রাবের বেগ আটকে রাখা কষ্টকর হওয়া।
৭। প্রস্রাব শেষ করতে বেশি সময় লাগা।
৮। মূত্রত্যাগের শুরুতে প্রস্রাব আসতে দেরি হওয়া।
৯। মূত্রত্যাগের পরেও মনে হয় প্রস্রাবের বেগ আছে ইত্যাদি ।
প্রোস্টেট ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট কারণ কিন্তু নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়নি, তবে কতগুলো বিষয় লক্ষ করা গেছে যেগুলো প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এগুলোকে বিপদের কারণ হিসেবে মনে করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে-
১। বয়স যত বেশি প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি তত বেশি।
২। প্রোস্টেট ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। প্রোস্টেট ক্যান্সারের কিছু জেনেটিক কারণ আজকাল আলোচিত হচ্ছে।
৩। প্রোস্টেট গ্রন্থির প্রদাহ ও এ রোগের যথাযথ চিকিৎসা না করা। প্রোস্টেটে প্রদাহ প্রায়ই দেখা যায় ।
৪। খাদ্যতালিকায় অতিরিক্ত চর্বি ও লাল মাংসের উপস্থিতি।
৫। সিগারেট, তামাক সেবন।
৬। পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের উপস্থিতি প্রোস্টেট ক্যান্সার দ্রুত বৃদ্ধি ও বিস্তারে সাহায্য করে থাকে।
ডায়াবেটিসের নতুন চিকিৎসা
চিত্র-২: ডায়াবেটিস পরিক্ষা
অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াস একটি মিশ্র গ্রন্থি। আমাদের পেটের ভেতরে লিভারের পাশেই এর অবস্থান। অগ্ন্যাশয় থেকে হরমোন এবং এনজাইম দুই’ই বের হয়। অগ্ন্যাশয়ে থাকে ‘আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যানস’। আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যানস-এ বিভিন্ন কোষ থাকে। আলফা, বিটা, ডেল্টা এবং পিপি কোষ।
এসব কোষ থেকে বিভিন্ন হরমোন বের হয়ে বিভিন্ন কাজ করে। বিটা কোষ থেকে বের হয় ইনসুলিন। ইনসুলিন রক্তের গ্লুকোজকে শরীরের বিভিন্ন কোষের কাজে লাগাতে প্রয়োজন হয়, ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। আর তাই ইনসুলিনের অভাবে রক্তের গ্লুকোজ খরচ না হয়ে তা বেড়ে গেলে হয় ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস প্রধানত ২ ধরনের। টাইপ ১ এবং টাইপ ২। টাইপ ১-এ সব বিটা কোষ নষ্ট হয়ে যায়। টাইপ ২-এর শেষের দিকেও বিটা কোষ নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন ইনসুলিন ছাড়া আর কোন সুযোগ থাকেনা। মুখে খাবার ওষুধ এসময় কাজ করেনা।
বর্তমানে তাই উন্নত দেশে আইলেট ট্রান্সপ্লান্ট করা হচ্ছে। মৃত ব্যক্তির অগ্ন্যাশয় থেকে আইলেট সংগ্রহ করা হয়। তারপর তা পোর্টাল ভেইন বা শিরায় ইনজেকশন করে দেয়া হয়। ফলে কোষগুলো পোর্টাল ভেইন দিয়ে লিভারে চলে যায়। তখন সেখান থেকে ইনসুলিন উৎপাদন শুরু হয়। রোগীকে আর বাইরে থেকে ইনসুলিন দেবার প্রয়োজন পড়ে না।
আইলেট ট্রান্সপ্লান্ট এর কিছু সমস্যা আছে। এটি যেহেতু অন্য ব্যক্তির কাছ থেকে নেয়া হয় তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিদ্রোহ করে বসে। নতুন আইলেটকে ধ্বংস করে দিতে চায় তারা। তাই বিদ্রোহ দমন করার জন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। এসব ওষুধ বেশ দামী এবং পার্শ্বপ্রতিক্রয়া অনেক।
বাইরের দেশে আইলেট ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। আশা করা যায় আমাদের দেশেও একসময় নিয়মিত এ ধরনের অপারেশন হবে।
স্ট্রোক হৃদযন্ত্রের কোন সমস্যা নয়
স্ট্রোক হৃদযন্ত্রের কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু অনেকেই এমনটি ভেবে থাকেন। এটি আসলে মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কের রক্তনালীর জটিলতার কারণে মস্তিষ্কের কোন এক অংশ কার্যকারিতা হারায়।
চিত্র-৪: মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ
স্ট্রোকের বিভিন্ন লক্ষণ থাকে। সবার ক্ষেত্রে কিন্তু লক্ষণ আবার এক হবে না। একেকজনের একেক লক্ষণ দেখা যায়। সচরাচর যেসব লক্ষণ দেখা যায় তার মধ্যে আছে-
১। হঠাৎ শরীরের একদিক অবশ বা দুর্বল হয়ে যাওয়া।
২। মাথাব্যথা ও বমি।
৩। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
৪। কথা জড়িয়ে যাওয়া।
৫। কথা বলতে না পারা।
৬। হাত পা ঝিন ঝিন করা।
৭। দুর্বলতা।
৮। খিঁচুনি ইত্যাদি।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে স্ট্রোকের কথা চিন্তা করতে হবে। কোনো রোগীর এসব লক্ষণ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বা নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়া উচিত। মস্তিষ্কের সিটিস্ক্যান করে স্ট্রোকের ধরন নির্ণয় করা হয়। কারণ রক্তনালী বন্ধ হলে যেমন স্ট্রোক হয় আবার রক্তনালী ফেটেও কিন্তু স্ট্রোক হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক হলে হৃদপিণ্ডের রক্তনালী বন্ধ হয়ে যায় । সাধারণত বুকে ব্যথা হওয়াটা সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ। হঠাৎ করে বুক ভীষণ চেপে ধরে। মনে হয় বুকের মধ্যে অনেক ওজন চেপে গেছে। এটা হয় শুরুতে এবং এর সাথে সাথে অনেকের শরীরে ঘাম হতে থাকে।
পাশাপাশি অনেক সময় মাথা ঘুরতে থাকে, বমি হতে থাকে। আবার বমি সবসময় নাও হতে পারে। তবে বুকে ব্যথা হওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাথা অনেক সময় চোয়াল বা হাতের দিকে চলে আসে। এরকম হলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। আর স্ট্রোক হলে নিউরোলজিস্ট দেখাতে হবে।
অনেকেই এই ভুল করে থাকেন। এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। এই বিষয়ে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ১০০ গ্রামের বেশি যারা লাল মাংস খান, তাঁদের হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকি ১৫ শতাংশ, ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি ১১ শতাংশ এবং বৃহদন্ত্র ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি।
শরীরের জন্য লাল মাংসের প্রয়োজন আছে তবে লাল মাংসের প্রধান ক্ষতি হলো, এর উচ্চ মাত্রার ট্রাইগ্লিসারাইড (টিজি) ও এলডিএল, যা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত। সুতরাং লাল মাংস বেশি খেলে সমস্যা হবেই। লাল মাংস যেহেতু প্রোস্টেট ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায় তাই লাল মাংস খাওয়া অবশ্যই কমাতে হবে।
বেশি বয়সী, যাঁদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ২০০-এর বেশি, তাঁদের রেড মিট বা লাল মাংস না খাওয়াই ভাল। স্থূলতা, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ বা হৃদরোগীদের লাল মাংস যথাসম্ভব বর্জন করতে হবে কিংবা একেবারেই কম খেতে হবে।
যাদের প্রোস্টেট ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস আছে তাদের অবশ্যই লাল মাংস বর্জন করতে হবে। তাহলেই প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।
নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৪
No Comment