।ডাঃ মোঃ ফজলুল কবির পাভেল।
পিত্তথলির পাথর
পিত্তথলি আমাদের লিভার বা যকৃতের নিচের দিকে থাকে। যেখানে লিভার থেকে বাইল বা পিত্ত এসে জমা থাকে এবং পিত্তথলিতে পিত্তরস ঘন হয়। আমরা যখন চর্বিজাতীয় খাবার খাই তখন হজমের জন্য পিত্তথলি থেকে বাইল বেরিয়ে আমাদের খাদ্যনালিতে চলে আসে এবং হজমে সহায়তা করে।
এই পিত্তরসের বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি হয় পিত্তথলির পাথর। কোলেস্টেরল স্টোন, পিগমেন্ট আর মিশ্র এই তিন ধরনের পাথর শরীরে দেখা দেয়। তবে এদের মধ্যে কোলেস্টেরল স্টোন বেশি হয়।
পিত্তথলিতে পাথর হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন উপসর্গ থাকেনা। প্রায় ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই ধরা পরে বিভিন্ন চেকআপের সময়। আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষায় পিত্তথলির পাথর ধরা পড়ে। পিত্তথলির পাথর থাকলে অনেকসময় পেটের ডানদিকে তীব্র ব্যথা হয়।
এ ব্যথার স্থায়িত্বকাল কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। ব্যথা ধীরে ধীরে ডান কাঁধ বরাবর ছড়িয়ে পড়ে। এসময় হালকা জ্বর থাকতে পারে, বমি বা বমি ভাব থাকে। পাথর যদি পিত্তনালিতে চলে আসে তখন দেখা দেয় জন্ডিস।
পিত্তথলির পাথর চিকিৎসার প্রধান উপায় হলো অপারেশন। দুইভাবে তা করা যায়। পেট কেটে আর লেপারস্কোপিক মেশিনের সাহায্যে। তবে লেপারস্কপিক মেশিনের সাহায্য অপারেশন সুবিধাজনক। রক্তপাত কম হয়, দাগ থাকেনা এবং একদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। সবসময় আবার লেপারস্কপিক অপারেশন সম্ভব হয়না। সেক্ষেত্রে কেটে করতে হয়।
পাথর থাকা সত্ত্বেও অপারেশন করা না হলে পিত্তথলির প্রদাহ হতে পারে। এর ফলে পেটের ডান দিকে তীব্র ব্যথাসহ জ্বর আসতে পারে এবং বমিও হতে পারে। এ ব্যথা কাঁধ পর্যন্ত ছড়াতে পারে। পিত্তথলির পাথর মূল পিত্তনালিতে এসে জমা হতে পারে।
তখন বাইল শরীর থেকে বের না হতে পেরে শরীরে বেড়ে যায়। দেখা দেয় জন্ডিস। এছাড়া অপারেশন না করলে প্যানক্রিয়েটাইটিস বা অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ হতে পারে। পিত্তথলির পাথর মূল পিত্তনালি থেকে নেমে অগ্ন্যাশয়ের নালিতে আটকে গিয়ে একিউট প্যানক্রিয়েটাইটিস বা অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
এক্ষেত্রে হঠাৎ পেটের মাঝখানে তীব্র ব্যথাসহ প্রচুর বমি হতে পারে। ব্যথা পিঠেও ছড়িয়ে যেতে পারে। ব্যথা এতই তীব্র হয় যে, রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর না করলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। অনেক দিন পাথর থাকার জন্য পিত্তথলির ক্যান্সারও হতে পারে।
পিত্তথলির পাথর থাকলে তাই দ্রুত চিকিৎসক দেখাতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবহেলা করা যাবেনা। নাহলে বড় বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।
বুক ধড়ফড় করা
বুক ধড়ফড়ের অনেক কারণ আছে। কখনই বুক ধড়ফড় হয়নি এমন মানুষ পৃথিবীতে একজনও নেই। একটু টেনশনে যেমন বুক ধড়ফড় হয় আবার হার্টের বিভিন্ন অসুখেও এমনটি হয়। হার্টের কারণে বুক ধড়ফড়ের চিকিৎসা না হলে জটিলতা হতে পারে। তাই এই বিষয়ে জানা দরকার সবার।
হৃদরোগ বুক ধড়ফড়ের প্রধান কারণ। তবে থাইরয়েড হরমোনের সমস্যাতেও কিন্তু এমন হয়। থাইরয়েড হরমোন বেড়ে গেলে বুক ধড়ফড় করে। এরকম অনেক রোগী দেখতে পাওয়া যায়। রক্তশূন্যতার অনেক রোগী আমাদের দেশে দেখতে পাওয়া যায়।
আয়রনের অভাবেই মুলত আমাদের দেশে রক্তশূন্যতা হয়। মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত, পাইলসের সমস্যা এবং কৃমির আক্রমণে রক্তশূন্যতা হয়। এর ফলে কিন্তু লক্ষণ হিসেবে বুক ধড়ফড় করতে পারে। যে কোনো ধরনের ভয়-ভীতি পেলে মানুষের বুক ধড়ফড় করে।
আমাদের সমাজে জটিলতা বাড়ছে। বাড়ছে নানা অস্থিরতা। তাই বলা যায় বুক ধড়ফড় ও বাড়ছে! অত্যধিক মদপান বা বিভিন্ন নেশাজাতীয় বস্তু গ্রহণ এবং বেশ কিছু মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও বুক ধড়ফড় করে। চিকিৎসক এই ধরণের ওষুধ দিলে অবশ্যই রোগীকে বলে দিতে হবে।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্তু বুক ধড়ফড় করার প্রধান কারণ হৃদরোগ। টেনশন ছাড়া তাই বুক ধড়ফড় হলেই সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত। হৃদরোগের কারণে শুধু যে বুক ধড়ফড় করে তা নয়। এই কারণে শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যাথা, অস্থির লাগা, ঘাম হওয়া, মাথা ঘোরা, মাথা হালকা অনুভব করা, ব্যাথা হাতের দিকে চলে আসা এরকম অবস্থাও হতে পারে।
হার্টের বেশ কিছু জটিল রোগের কারণেও মানুষের মধ্যে বুক ধড়ফড় করার মতো লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে। এসবের মধ্যে আছে ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বা হার্টের ধমনীর সমস্যা, হার্টের বাল্বের সমস্যা, হার্টের জন্মগত ত্রুটি, কার্ডিও মায়োপ্যাথি, মাইয়ো কার্ডাইটিস, হার্ট-অ্যাটাক ইত্যাদি।
অ্যাজমার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ যেমন-ও সালবিউটামল থিউফাইলিন জাতীয় মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বুক ধড়ফড় করতে পারে। আরও বেশকিছু কারণে বুক ধড়ফড় করতে পারে। যদিও বিভিন্ন কারণে বুক ধড়ফড় হয়ে থাকে তবুও এমন হলে অবশ্যই চিকিৎসক দেখাতে হবে।
চেকআপের মাধ্যমে হৃদরোগ আছে কিনা তা অবশ্যই নির্ণয় করতে হবে। কারণ হৃদরোগের কারণে বুক ধড়ফড় সবচেয়ে মারাত্মক। তাই অবহেলা নয়। একটু অবহেলায় হারাতে হতে পারে প্রিয়জন। আমাদের সকলকে এই বিষয় নিয়ে সচেতন হতেই হবে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া
হাইপোগ্লাইসেমিয়া খুব পরিচিত সমস্যা। ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের এই সমস্যা হয়। বিশেষ করে যারা ইনসুলিন নেন তাদের এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। হাইপোগ্লাইসেমিয়াতে রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার পরিমাণ হঠাৎ করে কমে যায়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা তিন মিলিমোল/লিটারের কম হলে তাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে।
সাধারণত ইনসুলিন বা মুখে খাবার ডায়াবেটিসের ওষুধের ডোজ বেশি হলে এই সমস্যা হয়। তাছাড়া খাবারে শর্করার পরিমাণ কম হলে, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। সঠিক সময়ে খাবার না খেলে বা কোনো খাবার মিস করলেও হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা গেলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ। তবে দেরি হয়ে গেলে জটিল সমস্যাসহ আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুও হতে পারে। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলো ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জানা থাকা একান্ত জরুরি। এছাড়া তাদের কাছের মানুষেরও এই বিষয়ে অবশ্যই জানতে হবে। হাইপোগ্লাইসেমিয়া লক্ষণগুলোর মধ্যে আছেঃ
১। মাথা ঘোরা বা অস্বস্তি
২। শরীর ঘেমে যাওয়া
৩। মেজাজ খিটখিটে হওয়া
৪। ক্ষুধা লাগা
৫। অস্থিরতা
৬। বুক ধড়ফড় করা
৭। মাথাব্যথা
৮। হাত কাঁপা ইত্যাদি
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কারো এমন হলে দ্রুত গ্লুকোজ মাপতে হবে। বাসায় মেশিন না থাকলে চিনির শরবত বানিয়ে খেতে দিতে হবে এবং দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। অনেকের ঘুমের মধ্যেও হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। এর লক্ষণগুলো হলো ঘামে বিছানার চাদর ভিজে যাওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখা এবং দুর্বল লাগা।
শুরুতে যদি হাইপোগ্লাইসেমিয়ার চিকিৎসা না করা হয় তবে আক্রান্ত ব্যাক্তি অচেতন হতে পারেন। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তি মারাও যেতে পারেন। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলো দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্লুকোজ বা চিনি পানিতে মিশিয়ে পান করতে হবে।
চিনি বা গ্লুকোজ চার পাঁচ চামচ নিতে হবে। এ ছাড়া মধু অথবা ফলের জুস পান করা যেতে পারে। কিছুক্ষণ পর গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্তে গ্লুকোজ আবার পরিমাপ করতে হবে। এরপরও যদি হাইপোগ্লাইসেমিয়া ভাল না হয় তবে আবার গ্লুকোজ খেতে হবে। সমস্যা বেশি হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
অনেকসময় আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে গ্লুকাগন ইনজেকশন বা গ্লুকোজ স্যালাইন দিতে হবে। হাইপোগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধ করার জন্য ইনসুলিনের ডোজ ঠিক করে নিতে হবে। ইনসুলিন নেওয়ার ঠিক আধা ঘণ্টা পর খাবার খেতে হবে। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেতে হবে।
কোনো বেলার খাবার মিস করা যাবেনা। খাবারে যেন শর্করাজাতীয় খাবার কম না হয় সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। একটু সচেতন হলেই এই সমস্যা অনেক কমানো সম্ভব। হাইপোগ্লাইসেমিয়া থেকে যেহেতু মৃত্যুও হতে পারে তাই সচেতন হতেই হবে।
হাইপোথাইরয়ডিজম
থাইরয়েড আমাদের শরীরের একটি গ্রন্থির নাম৷ আমাদের গলার সামনে এটি থাকে৷ এই গ্রন্থির কাজ হল আমাদের শরীরের কিছু অত্যাবশ্যকীয় হরমোন তৈরি করা। শরীরে বিভিন্ন কাজ করে এই হরমোন। এই হরমোন তৈরি কম হলে তাকে আমরা বলি হাইপোথাইরয়ডিজম।
মেয়েদের এই অসুখ বেশি হয়। ছেলেদেরও এই সমস্যা হতে পারে তবে মেয়েদের তুলনায় অনেক কম হয়। হাইপোথাইরয়ডিজমে বিভিন্ন উপসর্গ থাকে। এসব উপসর্গের মধ্যে আছেঃ
১। ক্লান্তিভাব। একটুতেই রোগী হাঁপিয়ে ওঠে।
২। ওজন বেড়ে যাওয়া। কম খেলেও রোগীর ওজন বাড়তে থাকে।
৩। শীত বেশি লাগা।
৪। পায়খানা শক্ত হওয়া।
৫। দুর্বলতা। রোগী সবসময় দুর্বলতা অনুভব করে।
৬। মাসিক বেশি হওয়া। এর থেকে দেখা দেয় রক্তাল্পতা।
৭। হার্টের স্পন্দন ধীরে হওয়া। চিকিৎসক পালস দেখে বুঝতে পারেন।
৮। গলার স্বরের পরিবর্তন হয়।
৯। চামড়া শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যায়।
১০। চুল পড়ে যায়।
সবার যে একইরকম লক্ষণ থাকবে তা নয়। বিভিন্নজনের বিভিন্ন লক্ষণ থাকে। একজনের আবার সবগুলো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। হাইপোথাইরয়েডিজমে হরমোন কমে যায় বলেই এসব সমস্যা হয়। অভিজ্ঞ চিকিৎসক ইতিহাস নিয়ে এবং শারীরিক পরীক্ষা করে অনেকটাই এই রোগটি ধরতে পারেন।
নিশ্চিত হবার জন্য হরমোন মাপতে হয়। টি থ্রি এবং টি ফোর হরমোন কমে যায় এবং থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনের (টিএসএইচ) মাত্রা বেড়ে যায়। হাইপোথাইরয়েডিজমে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সকালে খালি পেটে হরমোন ওষুধ খাওয়া ভাল।
ওষুধ খাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে চা কফি বা খাবার খাওয়া ঠিক নয়। ভিটামিন সি খেলে হরমোন বেশি কাজে লাগে। হরমোনের ডোজ আস্তে আস্তে বাড়াতে হয়। রক্ত পরীক্ষা না করে ওষুধের ডোজ বদলানো কখনই উচিত নয়। এক থেকে দুই বছর অন্তর রক্ত পরীক্ষা করানো জরুরি। অনেকের সারাজীবন ওষুধ খেতে হতে পারে।
হাইপোথাইরয়েডিজম পরিচিত অসুখ। তাই এই বিষয়ে সবার জানা উচিত।
মার্চ-এপ্রিল ২০১৯। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৬
No Comment