।সাবরিনা সুমাইয়া।
তোমার বন্ধু রাহুল। প্রফুল্ল চেহারার হাসিখুশি ছেলে। বিষণ্ণতা তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না। কান্নাকাটি দূরের কথা, কখনো গোমড়া মুখেও দেখা যায় না তাকে।
সেই রাহুল এক সন্ধ্যায় তোমাকে ফোন দিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘বাবা ভীষণ অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। বড়সড় স্ট্রোক করেছে। ডাক্তার বলেছেন, মেজর একটা অপারেশন করতে হবে। সেজন্য বেশ কয়েক ব্যাগ রক্ত লাগবে। বাবার রক্তের গ্রুপ A পজিটিভ। তোর রক্তের গ্রুপও তো A পজিটিভ। তুই কি পারবি রক্ত দিতে?’
প্রাণপ্রিয় বন্ধুর এই মহাবিপর্যয়ের দিনে তুমি তার পাশে দাঁড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলে হাসপাতালে। রাহুলের কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দিলে। তারপর গেলে রক্ত দিতে।
গল্পের এই পর্যায়ে এসে তোমার মনে কি প্রশ্ন জেগেছে যে, কেন রক্ত দিতে হলে রক্তদাতা এবং গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ একই হতে হবে? অন্য গ্রপের রক্ত কেন দেয়া যায় না? দিলে কি সমস্যা হবে? তোমার রক্তের গ্রপ যে A পজিটিভ এটাই বা কিভাবে জানা গেল?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়েই এই লেখাটি।
প্রথমেই আসি রক্তের গ্রুপ বা ব্লাড গ্রুপিং এর ব্যাপারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রধানত দুই ধরনের ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম প্রচলিত আছে – ABO ব্লাড গ্রুপ আর Rh ব্লাড গ্রুপ। ABO ব্লাড গ্রুপে আছে চার ধরনের ব্লাড – A, B, AB আর O। আর Rh ব্লাড গ্রুপে আছে দুই ধরনের ব্লাড – Rh পজিটিভ আর Rh নেগেটিভ।
আমাদের গল্পটিতে তোমার রক্তের গ্রুপ A পজিটিভ। তাহলে, তোমার রক্তের গ্রুপের প্রথম অংশটি জানা যাবে ABO ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম থেকে। অর্থাৎ কারো রক্ত কোন গ্রুপের- A, B, AB নাকি O গ্রুপ তা জানা যায় ABO ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম থেকে।
আর Rh ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম থেকে জানা যাবে তোমার রক্তের গ্রুপের দ্বিতীয় অংশটি। অর্থাৎ কেউ শরীরে পজিটিভ না নেগেটিভ রক্ত বহন করছে তা জানা যায় Rh ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম থেকে।
চিত্র-১: আরএইচ ফ্যাক্টর
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয় কিভাবে?
রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয় রক্তের লোহিতকণিকার (RBC) আবরণীতে থাকা এন্টিজেনের উপস্থিতি থেকে। রক্তের গ্রুপ A হলে RBC তে থাকবে a এন্টিজেন, রক্তের গ্রুপ B হলে b এন্টিজেন আর রক্তের গ্রুপ AB হলে a ও b দুইটি এন্টিজেনই থাকবে।
আর রক্তের গ্রুপ যদি হয় O তাহলে কোন এন্টিজেনই থাকবে না। আর RBC-এর আবরণীতে যদি Rh এন্টিজেন থাকে তাহলে রক্ত পজিটিভ, না থাকলে নেগেটিভ।
এখন তোমার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে রক্তে এন্টিজেন ব্যাটার থাকা না থাকাটাই কি সব? বুঝব কি করে কোন এন্টিজেন লুকিয়ে আছে আমার RBC-এর পর্দার আড়ালে?
চিত্র-২: অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি
হুম, ভাল প্রশ্ন। কোন এন্টিজেন আছে বা আদৌ আছে কিনা এটা বোঝা যায় এন্টিজেনের জাতশত্রু এন্টিবডিকে ধরে নিয়ে আসলে। এজন্য তোমার আঙুলে আলতোভাবে ফুটো করে একটা স্লাইডে তিন ফোঁটা রক্ত নেয়া হবে। তাতে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ফোঁটাতে যোগ করা হয় যথাক্রমে জানা এন্টিবডি Anti-A, Anti-B ও Anti-D ।
তখন যদি এন্টিজেন-এন্টিবডি বিক্রিয়া হয় অর্থাৎ এন্টিবডি যদি তার দোস্ত এন্টিজেনকে চিনতে পেরে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসে তাহলে সব RBC-রা একজোট হয়ে বিদ্রোহ করে। RBC-দের একসাথে হওয়ার এই ঘটনাকে বলে ctotting বা রক্ত জমাট বাঁধা।
জমাট বাঁধা রক্ত দেখলে মনে হয় এটি লাল আর হলুদ দুইটি অংশে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। লাল অংশটি লোহিত রক্তকণিকা বা RBC আর হলুদ অংশটি হচ্ছে সেরাম। এন্টিবডি যোগ করার পর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটতে পারে-
ঘটনা-১: যদি Anti-A যোগ করা রক্তের ফোঁটাটি লাল-হলুদ অংশে বিভক্ত হয় তাহলে বুঝতে হবে তোমার রক্তের গ্রপ A ।
ঘটনা-২: যদি Anti-B যোগ করা রক্তের ফোঁটাটি জমাট বাঁধে তাহলে তোমার রক্তের গ্রুপ B ।
ঘটনা-৩: যদি দুটো রক্তের ফোঁটাই জমাট বাঁধে তাহলে তোমার রক্ত AB গ্রুপের।
ঘটনা-৪: যদি দুটোর কোনটিই জমাট না বাধে তাহলে তোমার রক্তের গ্রুপ O ।
এখন, অবশিষ্ট থাকল তৃতীয় রক্তবিন্দু। এতে যোগ করা হয়েছে Anti-D। এক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। যদি রক্ত জমাট বাঁধে তাহলে রক্তের গ্রুপ Rh পজিটিভ আর না বাঁধলে নেগেটিভ।
চিত্র-৩: রক্তের গ্রুপিং
এখানে আরও কিছু মজার ব্যাপার আছে। তোমার অন্য এক বন্ধু শুভ্রর রক্তের গ্রুপ O । শুভ্র সবাইকে রক্ত দিতে পারবে। কারণ, O গ্রুপের রক্তে কোন এন্টিজেন থাকেনা। তাই শরীরে O গ্রুপের রক্ত দেয়া হলে এন্টিবডি এসে ঝামেলা করার কোন সুযোগই পাবে না। এজন্য O (নেগেটিভ) ব্লাড গ্রুপকে বলা হয় Universal Donor ।
আবার, তোমার আরেক বন্ধু তপুর রক্তের গ্রুপ AB। সে সব গ্রুপের রক্ত নিতে পারবে। এজন্য AB ব্লাড গ্রুপকে বলা হয় Universal receiver । এখন সেই মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, কেন তোমাকে রাহুল তার বাবার সাথে তোমার ব্লাড গ্রুপ মেলে বলে তোমাকে রক্ত দিতে বলল? অন্য গ্রুপের রক্ত দিলে কি হবে?
যদি দাতার ব্লাড গ্রুপ গ্রহীতার ব্লাড গ্রুপের সাথে না মেলে তাহলে নয় নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখা দেবে।
আমাদের গল্পে, রাহুলের বাবার রক্তের গ্রুপ A পজিটিভ। এখন তাকে যদি রাহুলের বাবার বন্ধুর B পজিটিভ রক্ত দেয়া হয় তাহলে রাহুলের বাবার বন্ধুর রক্ত রাহুলের বাবার রক্তপ্রবাহে মিশ্রিত হবার সাথে সাথে রাহুলের বাবার শরীর কাঁপাকাঁপি শুরু করে দেবে, শরীরে অস্থিরতা ভর করবে, বমি বমি ভাব দেখা দেবে, তিনি বুকে-পিঠে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করবেন, তার শ্বাসপ্রশ্বাস ও পালস্ রেট বেড়ে যাবে, রক্তচাপ কমে যাবে।
কিছুদিন পর আরও কিছু সমস্যা দেখা দেবে। যেমন- তার লোহিত রক্তকণিকা ভাঙতে শুরু করবে (Hemolysis)। ফলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাবে এবং তিনি জন্ডিসে আক্রান্ত হবেন। এরপর তার কিডনী বিদ্রোহ করবে এবং সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে (Acute renal shutdown)।
চিত্র-৪: লোহিত রক্তকণিকার ভাঙন
ফলে একসপ্তাহের মাথায় তিনি মারা যাবেন। বুঝতেই পারছ কতটা ভয়াবহ ব্যাপার।
দাতা ও গ্রহীতার রক্ত যদি একই গ্রুপের হয় তাহলেও এত নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নাই। বিপদ ঘটতে পারে সেক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক বিপদ হিসেবে দেখা দিতে পারে জ্বর, এলার্জি, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রভৃতি। প্রলম্বিত বিপদ হিসেবে রক্তে অবাধ অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে ভয়াবহ কিছু রোগজীবাণুর (যেমন- ভাইরাল হেপাটাইটিস, এইডস, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর) ।
তবে আশার কথা এই বিপদগুলো ঠেকানো যায় খুব সহজেই।
এজন্য রক্ত দেয়ার আগে কিছু টেস্ট করাতে হয়।
১. ক্রস ম্যাচিং: দাতার রক্ত গ্রহীতার শরীরে প্রদান করা হলে কোন সমস্যা হবে কিনা তা জানা যায় ক্রস ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে। এটি একটি মজার টেস্ট। এতে দাতার লোহিত রক্তকণিকা (এন্টিজেন) আর গ্রহীতার সেরাম (এন্টিবডি) মিলিয়ে দেখা হয় রক্ত জমাট বাঁধে কিনা।
জমাট বাঁধলে রক্ত দেয়া যাবে না, না বাঁধলে দেয়া যাবে। এক্ষেত্রে দাতার সেরামকে খুব একটা পাত্তা দেয়া হয়না কারণ গ্রহীতার সেরামের পরিমাণ বেশি থাকে।
২. স্ক্রিনিং: দাতার রক্তে রোগজীবাণু আছে কিনা পরীক্ষা করা হয়।
কখন রক্ত দিতে হবে?
বড় ধরনের অপারেশন করতে হলে বা কোন কারণে শরীর থেকে ২ লিটারের বেশি রক্ত বেরিয়ে গেলে (যেমন-সড়ক দুর্ঘটনা) বা শরীরের অনেকটা অংশ পুড়ে গেলে রক্ত দিতে হয়। এছাড়া রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে বা ব্লাড ক্যান্সার হলেও রক্ত দেয়ার প্রয়োজন পড়ে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্লাড ব্যাংকে রাখা রক্ত দিলেও চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার ফ্রেশ ব্লাড দিতে হয়। যেমন-থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের ফ্রেশ ব্লাড দিতে হয়।
এখন নিশ্চয়ই তোমার জানতে ইচ্ছা করছে ব্লাড ব্যাংকে রক্ত কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়। ব্লাড ব্যাংকে রক্তকণিকাগুলো ও রক্তরসসহ (whole blood) রক্ত সংরক্ষণ করা হয় আবার রক্তকণিকাগুলো (RBC, WBC, Platelet) আলাদা করেও সংরক্ষণ করা হয়।
শরীরে রক্ত জমাট বাঁধে না কেন জানো? শরীরে হেপারিন নামের প্রাকৃতিক জমাটরোধক থাকে বলে। তাহলে শরীরের বাইরে রক্তকে জমাট না বাঁধিয়ে সংরক্ষণ করতেও লাগবে জমাটরোধক (anticoagulent) । ব্লাড ব্যাংকে কৃত্রিম জমাটরোধক ব্যবহার করা হয়। যেমন- হেপারিন, EDTA, সোডিয়াম সাইট্রেট প্রভৃতি।
ব্লাড ব্যাংকে সাধারণত রেফ্রিজারেটরে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রক্ত সংরক্ষণ করা হয়। এই তাপমাত্রাটি হয় সাধারণত ২-৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। হয়ত জানতে চাইবে, ব্লাড ব্যাংকে কি যতদিন খুশি রক্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায়? রক্তের গুণাগুণ কি এতে ঠিক থাকে নাকি পরিবর্তিত হয়?
ব্লাড ব্যাংকে সাধারণত ৩৬-৪৫ দিন পর্যন্ত রক্ত সংরক্ষণ করা যায়। দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করলে রক্তের গুনাগুণ অবশ্যই হ্রাস পাবে। এতে করে রক্তে লোহিত রক্তকণিকা কমে যায়। pH এর ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। Na+ সহ অনেক আয়ন কমে যায়। রক্তের প্রোটিন, ক্লটিং ফ্যাক্টরের কার্যকারিতা কমে যায়। রক্তে থাকা হরমোনেও এমনকি পরিবর্তন আসে।
মে-জুন ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ১
No Comment