।ফাইয়াজ ইফাজ।

সৃষ্টিজগতের অপার বিস্ময়ের মধ্যে অন্যতম বিস্ময়কর স্থান হচ্ছে পৃথিবী যার চার ভাগের তিন ভাগই জলরাশি দ্বারা বিস্তৃত। জলভাগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আরেক বিস্ময়কর জগৎ। সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর জীবজগত তাদের অস্তিত্বকে  টিকিয়ে  রাখছে। সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে গাছপালা পানি ক্লোরোফিল, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করে থাকে যা  আমাদের শরীরে বিভিন্ন উপায়ে প্রবেশ করে বেঁচে থাকার শক্তি যোগান দেয়। সাধারণত জীব খাদ্যের জন্য সৌর শক্তির উপর নিভর্রশীল। কিন্তু প্রশ্ন হলো গভীর সমুদ্রে সৌরশক্তি না পৌঁছানোর দরুন কীভাবে সামুদ্রিক জীব-জগত গভীর সমুদ্রে তাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে  রাখে?  

রহস্যময় পৃথিবীতে যেন রহস্যের কোনো শেষ নেই। এটিও রহস্য বটে। মূলত এখানে একধরনের রাসায়নিক  বিক্রিয়া সংঘটিত হয় যা কেমোসিনথেসিস (রাসায়নিক সংশ্লেষন) নামে পরিচিত। এই বিক্রিয়ার ফলে সামুদ্রিক জীব-জগত খাদ্য প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পেয়ে থাকে। এই কেমোসিনথেসিস হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের (জলতাপ নিঃসরণ ছিদ্র) আশে পাশে হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো হাইড্রো থার্মাল ভেন্ট কি।  

হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট তাহলে কী?

পৃথিবী পৃষ্ঠের যে ফাটল দিয়ে ভূ-তাপের ফলে উত্তপ্ত পানি নির্গত হয়, সে ফাটলকে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট বলে। গভীর সমুদ্রের লবণাক্ত পানি যখন গরম ম্যাগমার সাথে মিশে তখন চমকপ্রদ এই ঘটনার উদ্ভব ঘটে,পানির তাপমাত্রা প্রায় ৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে পৌঁছায়। এই ভেন্ট অন্য গ্রহেও পাওয়া যায়। পৃথিবীতে মূলত সক্রিয় আগ্নেয়গিরির আশেপাশে, হটস্পটে যেখানে টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংঘর্ষ ঘটে, সেখান থেকে প্রচুর পরিমান নিউট্রিয়েন্ট ও বিষাক্ত  উপাদান, গ্যাসীয় হাইড্রোজেন সালফাইড নির্গত হয়।

 

১৯৭৭ সালে সর্বপ্রথম গ্যালোপোগাস দ্বীপের আশেপাশে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট আবিষ্কৃত হয়। ভেন্ট থেকে নি:সৃত উত্তপ্ত পানি আশেপাশের পাশের ঠান্ডা পানির সাথে মিশ্রিত হয়ে নকল ফোয়ারা তৈরি করে। অনেকসময় প্রচুর পরিমান নিউট্রিয়েন্টস ও বিষাক্ত উপাদান বহন করায় এদের দেখতে কালো দেখায়। তাই এদেরকে ব্ল্যাক স্মোকারও বলে। এই  ভেন্টগুলো  চিমনি তৈরি করে থাকে।  নিগর্ত খনিজ উপাদান ও বিষাক্ত উপাদানগুলো ভেন্টের মুখে পুঞ্জিভূত হয়ে বিশাল চিমনির সৃষ্টি করে যেখান দিয়ে উত্তপ্ত পানি বের হয়। এই চিমনিগুলো উচ্চতায় ৬০ মিটারের চেয়েও বেশি হয়। চিমনিগুলো খুব দ্রুতই তাদের উচ্চতা বৃদ্ধি করে, প্রায় প্রতিদিনই  ৩০ সেমি করে বৃদ্ধি পায়। ভেন্টগুলো ১০০ থেকে ১,০০,০০০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে যদিও পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারনে এরা দ্রুতই ধ্বংস হয়ে যায়।

বিজ্ঞানীরা বলেন যে, গভীরতম সমুদ্রের তলদেশের প্রাণী বৈচিত্র্যের ঘনত্বের চেয়ে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের প্রাণী বৈচিত্র্যের ঘনত্ব অনেক বেশি। এমনকি অনেক প্রাণী হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের আশেপাশে বিদ্যমান আছে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ গভীর সমুদ্রের তলদেশে সূর্যালোক পৌঁছায় না ফলে সমুদ্রের উপরের স্তরে থেকে নিচের পড়া খাদ্যের উপর নির্ভর করতে হয়। এটাকে মেরিন স্নো বলে। হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের প্রাণচক্রটি চলে রাসায়নিক  সংশ্লেষন সম্পন্ন ব্যাকটেরিয়া  দ্বারা। কেমোসিনথেসিসের কারনে ভেন্টে অনেক নিউট্রিয়েন্ট নিগর্ত হয় যা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করায় পরিণত হয়। এখানের প্রধান খাদ্য উৎস হলো হাইড্রোজেন সালফাইড যা বিভিন্ন উপায়ে শর্করায় পরিণত হয়।

CO2+H2O+H2S→ [CH2O]+H2SO4

 

হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট মূল সামুদ্রিক শৈলশিরা বরাবর গঠিত কারন দুটি টেকটোনিক  প্লেটের কেন্দ্রবিমুখীতার দরুন নতুন মহাসাগরীয় ভূ-ত্বক গঠনের আগে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের গঠনের যাত্রা শুরু হয়। ভেন্টের আশেপাশে যেসব প্রাণী পাওয়া যায় তার অধিকাংশই ক্যামোসিনথেটিক (chemosynthetic) ব্যাকটেরিয়া, টিউব ওয়ার্ম, চিংড়ি, পলিকিট ঝিনুক, মাসল, আ্যামপিপোড, কাকড়া, অক্টোপাস, কিছু মাছ। ঝিনুক, মাসল, টিউব ওয়ার্ম এগুলোতে সিমবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া  আছে। ব্যাকটেরিয়া  তাদের খাদ্য প্রদান করে, তাদের কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে কার্বোহাইড্রেট  তৈরি করে একটি টিউব ওয়ার্ম। প্রতি গ্রাম টিস্যুতে ১০ হাজার মিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া  বহন করে।

ভেন্টের আশেপাশে তাপমাত্রা ৫০ থেকে ৪০০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা  থাকে। এদের কিছু অম্লীয় অথবা ক্ষারীয় প্রকৃতির হয়ে থাকে। ভেন্ট প্রধানত দুই ধরনের- ১.ব্ল্যাক স্মোকার ২.হোয়াইট স্মোকার

 

জার্মান  বিজ্ঞানী গানটার (gunter) আয়রন সালফার থিউরিতে দাবি করেন যে, আদিমতম প্রাণের উৎপত্তি ঘটেছে এই হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের আশেপাশের অঞ্চলে। কারন এখানে মিথেন ও অ্যামোনিয়ামের প্রাচুর্য  রয়েছে কিন্তু বায়ুমণ্ডলে তাদের অস্তিত্ব চিন্তা করা আকাশ কুসুম কল্পনার শামিল। গানটারের মতামতের অন্যতম দুবর্লতা ছিল উচ্চ তাপমাত্রা ও বিষাক্ত পরিবেশে কিভাবে প্রাণের উৎপত্তি সম্ভব? কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এই দুর্বলতা দূর করেন। তারা দেখান যে, উচ্চ তাপ ও বিষাক্ত পরিবেশে অনেক প্রাণী বাস করতে পারে। এদের ইসট্রিমোফাইল বলে। যেমন-পম্পেই নামক টিউব ওয়ার্ম ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রায় বেচে থাকার জন্য এদের শরীরে প্রয়োজনীয় এনজাইম ও ব্যাকটেরিয়াগুলো রাসায়নিক সংশ্লেষনক্ষম হওয়ায় এখানে প্রাণের প্রাচুর্যতা দেখা যায়।

আমাদের হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট আবিষ্কার ও এর রাসায়নিক  পরিবেশ সম্পর্কে  জেনে কি লাভ? মানব ইতিহাসের সকল আবিষ্কারই মানবজীবনের নতুন দিগন্তের দরজা খুলে দেয়। সুতরাং হাইড্রোথার্মাল ভেন্টও সামুদ্রিক প্রাণ রহস্যের দরজা খুলে দিয়ে আমাদের সমুদ্র বিজ্ঞান নিয়ে জানার জন্য তৃষ্ণার্ত মনকে শীতল করতে সহায়তা করছে।

 

  • হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের মাধ্যমে সমুদ্রের গভীরে পানির রসায়ন সম্পর্কে জানতে পারি। সমুদ্রের পানি কেন লবণাক্ত তা আবিষ্কারে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। কারণ প্রচুর পরিমানে নিউট্রিয়েন্টস সামুদ্রিক পানির সাথে মিশ্রিত হয়।
  • যেহেতু ভেন্ট থেকে নি:সৃত পানি অনেক উত্তপ্ত থাকে, তাই সমুদ্রের তাপমাত্রায় বিরাট ভূমিকা পালন করে।
  • ক্যামোসিনথেটিক ব্যাকটেরিয়া তাদের অনন্য এন্টিবায়োটিক ও এনজাইমের মাধ্যমে ওষুধ শিল্পে কাঁচামালের যোগান দেয়।
  • এখান থেকে বিপুল পরিমান খনিজ উপাদান আহরণের সম্ভাবনা আছে।
  • প্রতিবছর নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয় এই হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট থেকে।
  • ব্যাকটেরিয়াগুলো যেহেতু বিষাক্ত উপাদানকে রাসায়নিক উপাদানে পরিণত করে তাই একে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করা যায়।
নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৪