।মোঃ মোখলেছুর রহমান।
(পর্ব-০৪)
তোমাদের মনে অবশ্যই প্রশ্ন দানা বেঁধে আছে! আমাদেরকে কে নিয়ন্ত্রণ করবে? হ্যাঁ, বন্ধুরা এ পর্বেই তা থাকছে। আর তোমাদের হয়তো মৌমাছিসহ গত পর্বের মস্তিষ্ক দখলকারী পরজীবীদের কথা মনে আছে। এ পর্বেও নতুন কিছু থাকছে।
যা তোমাদের জানার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিবে। সৃষ্টির সেরা জীবকে পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে কেউ না পারলেও আংশিক করে থাকে। আজ তা নিয়ে আলোচনা করবো।
চিত্র-১: নীল প্রজাপতি
তোমরা তো অবশ্যই প্রজাপতি অনেক পছন্দ করো তাই না! আজ প্রজাপতির গল্প শুনাই। কিছু প্রজাপতি তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য শুঁয়োপোকাকে বেছে নেয়। প্রজাপতির ডিম গাছের কাণ্ডে বা পাতায় ছড়িয়ে রাখে। এসব ডিম শুঁয়োপোকা খাদ্য হিসাবে খেয়ে ফেলে।
এই ডিম শুঁয়োপোকার পেটে মথে পরিণত হয়। মথগুলো একধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে। শুঁয়োপোকাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে মথগুলো প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে। মথগুলো উপযুক্ত সময়ে শরীর থেকে নিজেদের বের করায়। এটুকু করেই মথগুলো ক্ষান্ত হয় না।
বরং মথগুলোর নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ মৃত্যু পর্যন্ত ক্রিয়ারত থাকে। মথগুলো নিজেকে পাহারা দিতেও শুঁয়োপোকাকে বাধ্য করে। শুঁয়োপোকা মথগুলোর জন্ম পর্যন্ত পাহারা দেয়।
চিত্র-২: সতর্ক শুঁয়োপোকার মথ পাহারা
এমনকি খাদ্য গ্রহণ থেকেও কিছুটা বিরত রাখে। শুঁয়োপোকার মৃত্যু ঘটায়। মথগুলো থেকে প্রজাপতির জন্ম হয় এবং ঐ শুঁয়োপোকাকে খেয়ে ফেলে। এভাবে প্রজাপতি জীবনচক্র চলতে থাকে। কি সাংঘাতিক তাই না? ভাবতে কেমন লাগে বলো!
চিত্র-৩: নীল প্রজাপতির জীবনচক্র
বোলতার কথা মনে আছে তো! এখন জানবো বোলতাকে আবার কেউ নিয়ন্ত্রণ করে কি না। হ্যাঁ, এই নিয়ন্ত্রণের রাজা বোলতাও রক্ষা পায় না। মনে আছে তো বোলতার কথা? পূর্বের পর্বগুলো পড়লে মনে থাকবে নিশ্চয়ই। বোলতা কতোটা ভয়ানক। মহান স্রষ্টার সৃষ্টির দিকে তাকালে বিস্ময় লাগে। তিনি কতো মহান। সব সৃষ্টির মাঝে সাম্যতা করেছেন।
চিত্র-৪: আক্রান্ত বোলতা
জেনাস ভেস্প্যারাম (Xenos vesparum) নামক পরজীবী বোলতার পেটে সবসময় থাকে। পরজীবীগুলো এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে। বোলতাকে যৌন মলনে বাধ্য করে। এই পরজীবীগুলোর পুং ও স্ত্রী প্রজাতি আলাদা বোলতার শরীরে থাকে।
পুং পরজীবী বোলতার শরীর থেকে বের হয়। বোলতা মারা যায়। স্ত্রী পরজীবীযুক্ত বোলতার শরীরে প্রবেশ করে। স্ত্রী পরজীবীযুক্ত বোলতা মোটা হয়ে যায়। রাণী বোলতায় পরিণত হয়।
চিত্র-৫: জেনাস ভেস্প্যারামযুক্ত বোলতার পূর্ণ চিত্র
পরজীবীর ডিম বিভিন্ন বোলতার শরীরে ছড়িয়ে দেয়। জেনাস ভেস্প্যারাম পরজীবী তাদের প্রজননে বাধ্য করে। এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সৃষ্টি যত ভয়ঙ্করই হোক! তাকে কেউ না কেউ শায়েস্তা করে, তাই না? কি সুন্দর এই পৃথিবী। কেউ পার পেয়ে যায় না।
এবার আশরাফুল মাখলুকাত নিয়ে কিছু শোনা যাক। কি বলো। আমরা অনেকেই গরুর মাংস খেতে অনেক পছন্দ করি। কিন্তু কখনেই চিন্তা করি কি? কেন মাংস এত পছন্দের? কেউ আবার তোমায় খাওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রণ করছে না তো! জিবে জল নিয়ে আসছে কে?
হ্যাঁ, তোমরা ফিতাকৃমির নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। ফিতাকৃমির জীবনচক্র সম্পন্ন হওয়ার জন্য দুটি পোষকদেহ প্রয়োজন। একটি হচ্ছে মুখ্যপোষক (মানুষ) এবং অপরটি হচ্ছে মাধ্যমিক পোষক (অত্যাধিক শুকর বা অল্প পরিমাণে গরু/ মহিষ)।
চিত্র-৬: ফিতাকৃমি
এরা মানুষের অন্ত্রে পরজীবী হিসেবে বসবাস করে। এদের মাথা চোষকের সাহায্যে অন্ত্রের প্রাচীরে আটকানো থাকে। এবং মুক্তভাবে ঝুলানো বাকি অংশের শেষদিকের খন্ডকগুলি (Proglottids) পরিপক্ক শুক্রাণু ও ডিম্বাণু বহন করে।
এই পরিপক্ক খন্ডকগুলি নিষিক্ত হবার পর বিচ্যুত হয়। এবং আশ্রয়দাতার মলের সাথে বাইরে বের হয়ে আসে। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ যেমন ভেজা ঘাসে খন্ডকগুলি ফেটে অনকোস্ফীয়ার (Onchosphere) অবস্থায় ভ্রূণগুলি বের হয়ে আসে। তৃণভোজী প্রাণিদের (যেমন: শুকর) ঘাস ভক্ষণের মাধ্যমে এ ভ্রূণ দশা তাদের দেহে প্রবেশ করে।
চিত্র-৭: ফিতাকৃমির ভ্রূণ দশা
ব্লাডার ওয়ার্ম দশা: ব্লাডার ওয়ার্ম দশা শুকরের মাংসপেশিতে অবস্থান করে এবং মানুষের দেহে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকে।
চিত্র-৮: ব্লাডার ওয়ার্ম দশা
ওয়ার্ম দশা: এ দশায় চোষক ও হুকসহ মাথা ভেতরে ঢুকানো থাকে।
চিত্র-৯: ওয়ার্ম দশা
লার্ভা দশা: ফিতাকৃমির লার্ভা দশা শুকরের ঐচ্ছিক মাংসপেশিতে বৃদ্ধি পায়।
চিত্র-১০: লার্ভা দশা
ভ্রূণগুলি ঘাসের উপরে জীবিত অবস্থায় থাকে এবং খাদ্য গ্রহণের সময় শুকরের দেহে প্রবেশ করে। পাকস্থলির জারক রসের সহায়তায় অনকোস্ফীয়ার ভেঙ্গে ভ্রণগুলি মুক্ত হয়। অন্ত্রে এসে এরা অন্ত্রপ্রাচীর ছিদ্র করে রক্তে চলে আসে। হৃৎপিন্ড দ্বারা বাহিত হয়ে এরা অবশেষে মাংসপেশিতে অবস্থান নেয়।
পরজীবীটির এ অবস্থানকে ব্লাডার ওয়ার্ম দশা বলে। অর্থাৎ শুকর বা গরুর রক্তের সাথে মিশে বিভিন্ন মাংশপেশিতে আশ্রয় নেয়। সক্রিয় ভ্রূণে রুপান্তরিত হয়। এই ভ্রূণগুলো ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে না। ভ্রূণ অবস্থায় মাংশপেশিতে জমা হয়ে থাকে। সংখ্যা বৃদ্ধি করে। মজা করে অসিদ্ধ ও বড় টুকরো কাবাব খেলে এ দশাটি মানুষের দেহে প্রবেশ করে।
চিত্র-১১: ফিতাকৃমির পূর্ণ জীবন চক্র
মানুষের অন্ত্রে এসে ব্লাডারটি খসে যায় কিন্তু স্কোলেক্সটি (Scolex) হুকের সাহায্যে অন্ত্রপ্রাচীরে আটকে থাকে। স্কোলেক্স দ্রুত নতুন খন্ডক সৃষ্টি করে তিন মাসের মধ্যে পূর্ণতা লাভ করে। এভাবে আমাদের শরীরের ফিতাকৃমি চক্রাকারে জীবন সম্পন্ন করে।
ফিতাকৃমি শরীরে এক ধরনের রাসায়নিক নিঃসৃত করে মাংস খাওয়ার জন্য আকৃষ্ট করে। তাই আমাদের সাবধান থাকতে হবে। অসিদ্ধ মাংশ বা সিদ্ধ বড় কাবাব না খেয়ে বেশী সিদ্ধ ছোট টুকরা খাওয়া উচিৎ। সকলের সচেতনতায় এসব পরজীবীর নিয়ন্ত্রণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
আজ আর না। তোমাদের ভালো লেগেছে নিশ্চয়ই। আশা করি পরবর্তী সংখ্যায় আরো নতুন কিছু থাকবে।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৩
No Comment