।পারভেজ মাহির।
সামি ভাইয়ের অফিসে সুন্দর টাইলস করা রুমে বসে আছি। আনমনে জগৎ সংসারের নানা বিষয় নিয়ে ভাবছি। হঠাৎ চোখ গেল ঘরের এক কোণের মেঝেতে। দেখলাম বর্গাকৃতির একটি টাইল (টাইলস বহুবচন, একবচনে টাইল) সুন্দরভাবে মেঝের এক কোণে সেঁটে আছে। বর্গাকার জিনিসের প্রতি কেন যেন আমার ভালবাসাটা একটু বেশিই। শুধু আমার না, সবারই হওয়ার কথা। চারদিকে সমান সুন্দর আকৃতির একটা জিনিসকে কে না ভালবাসবে! বর্গটার দিকে অনেকক্ষণ অপলক দৃষ্টে চেয়ে থাকলাম।
এই সুন্দর বর্গের যেকোন একপাশে আর একটি টাইল মিলে যদি চিন্তা করা হয়, তাহলে আর সেটা বর্গ থাকে না, হয়ে যায় আয়তক্ষেত্র। আয়তক্ষেত্রকে বর্গের মতন অতটা ভালবাসি না, তাই আবার কীভাবে বর্গ বানানো যায় সেই চিন্তা করতে লাগলাম। খেয়াল করলাম, একটি টাইলের ছোট একটি বর্গের জায়গায় বড় একটি বর্গ পেতে হলে এর সাথে আমাকে আরও তিনটি বর্গাকার টাইলস লাগাতে হবে, তাহলে আগের ছোট বর্গের তুলনায় আর একটু বড় বর্গ পাওয়া যাবে।
অর্থাৎ প্রথমে ১টা টাইল নিয়ে একটি বর্গ, এরপর এর সাথে আরও ৩টি টাইলস মোট ৪টি নিয়ে হল একটি বড় বর্গ। এরপরের বর্গ পেতে হলে এই চারটির বাইরের দুইপাশের আরও ৫টি টাইলস যোগ করতে হবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে,
১
১+৩ = ৪
৪+৫ = (১+৩)+৫ = ৯
৯+৭ = (১+৩+৫)+৭ = ১৬
১৬+ ৯ = (১+৩+৫+৭)+৯ = ২৫
কী সুন্দর সিকুয়েন্স, তাই না? ১ থেকে শুরু করে পর পর কয়েকটি বিজোড় সংখ্যা যোগ করলেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি একটি করে বর্গ তথা বর্গসংখ্যা। এটা দেখে কিছু মনে পড়ে কি? যাদের মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ধারার অঙ্ক করার সুযোগ হয়েছে, তাদের নিশ্চয় এই ধরনের একটা অঙ্ক করে থাকার কথাঃ
১ + ৩ + ৫ + ৭ + …………………………… + (২n-১) = n২
অর্থাৎ প্রথম n সংখ্যক বিজোড় স্বাভাবিক সংখ্যার সমষ্টি হচ্ছে n2।
১ = ১ (প্রথম ১টি বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি ১২ = ১ !!!)
১+৩ = ৪ (প্রথম ২টি বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি ২২ = ৪)
১+৩+৫ = ৯ (প্রথম ৩টি বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি ৩২ = ৯)
১+৩+৫+৭ = ১৬ (প্রথম ৪টি বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি ৪২ = ১৬)
১+৩+৫+৭+৯ = ২৫ (প্রথম ৫টি বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি ৫২ = ২৫)
এতদিন এই অঙ্কটি কেবল থিওরি আকারেই জানতাম, আজ সামি ভাইয়ের অফিসে বসে প্র্যাক্টিকালি অনেক সুন্দর এই বিষয়টি টাইলসের মাধ্যমে ভিজুয়ালাইজ করলাম J। বিষয়টি এত ভাল লাগল যে, এটা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দেখি, এই কনসেপ্ট থেকে আরও মজার একটি বিষয় বের হয়ে আসে, গণিতের পরিভাষায় যেটি একটি বিশেষ নামে খ্যাত। কী সেই নাম, একটু পরেই দেখি।
এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দেখলাম, ১ থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমিক কতগুলো বিজোড় সংখ্যা নিয়ে যোগ করলে যোগফল একটি বর্গ তথা বর্গসংখ্যা হয়। বিষয়টা আবার আমরা একটু ভিন্ন চিত্রের সাহায্যে দেখিঃ
আগের টাইলসের চিত্রটিকেই এবার গোল গোল করে দেখানো হয়েছে। এখানে, প্রতিটি চিত্রেই একটি ছোট বর্গের সাথে একটি নতুন বিজোড় সংখ্যা যুক্ত হয়ে একটি বড় বর্গ সংখ্যা তৈরি করেছে। নীচের ছক থেকে বিষয়টা আরও পরিস্কার হবে।
উপরের ছক থেকে এটা স্পষ্ট যে, একটি ছোট বর্গের সাথে একটি বিজোড় সংখ্যা যোগ করলে একটি বড় বর্গ পাওয়া যায়। আরও সঠিকভাবে বললে, একটি বর্গের সাথে ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ যোগ করলে ঠিক তার ‘পরের বর্গসংখ্যা’ পাওয়া যায়। এখন এই ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ নিজেই যদি একটা বর্গসংখ্যা হয়, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়! চিত্র-২ঘ তে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছে। ছক থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, চিত্র-২ঘ তে, ১৬ (=৪২) এর সাথে ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ ৯ যুক্ত হয়ে ২৫ (=৫২) তৈরি করেছে। এখন এই বিজোড় সংখ্যা ৯ নিজেই একটি বর্গ সংখ্যা (৯ = ৩২), তাহলে, আমরা লিখতে পারিঃ
১৬ + ৯ = ২৫
বা, ৪২ + ৩২ = ৫২
কী সুন্দর, তাই না! দুটি বর্গ সংখ্যা যোগ করে আর একটি বর্গ সংখ্যা পাওয়া গেল। মাধ্যমিকের গণ্ডিতে পা দেওয়া প্রত্যেকের কাছে এই সমীকরণটি খুবই পরিচিত হওয়ার কথা। ঠিক, পীথাগোরাসের উপপাদ্য।
চিত্র-৩
একটি সমকোণী ত্রিভুজের ভূমি ও লম্বের বর্গের যোগফল এর অতিভুজের বর্গের সমান। সহজভাবে,
ভূমি২ + লম্ব২ = অতিভুজ২
বা, a2 + b2 = c2
এখানে, a, b, c বাহু তিনটির মান যেকোন ভগ্নাংশ বা পূর্ণসংখ্যা হতে পারে। তিনটি বাহুর মানই যখন পূর্ণসংখ্যা হয়, তখন এই তিনটি পূর্ণসংখ্যাকে আমরা পীথাগোরাসের ত্রয়ী (Pythagorean Triple) বলে থাকি। যেমন, বাহু তিনটির মান যদি ৩, ৪ ও ৫ হয়, তাহলে উপরে আমরা যেমনটা দেখলাম, ৩২ + ৪২ = ৫২; যা একটি পীথাগোরাসের ত্রয়ী। এখন প্রশ্ন হলো, এরকম আরও ত্রয়ী হওয়া কি সম্ভব, যেখানে দুটি পূর্ণসংখ্যাকে বর্গ করে যোগ করলে আর একটি পূর্ণবর্গ পাওয়া যাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আবার আমরা ফিরে যাই উপরের ছকটিতে। আমরা দেখেছি, একটি বর্গের সাথে একটি ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ যোগ করলে আর একটি বর্গ পাওয়া যায়। এখন এই ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ টি কত হবে? ৪ এর বর্গ ৪২ = ১৬ এর সাথে ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ ৯ যোগ করে আমরা পেয়েছি ৫ এর বর্গ ৫২ = ২৫ (চিত্র-৫)
৪ এর বর্গ ১৬ এর সাথে ৯ কেন যোগ করলাম? বিষয়টা ভালভাবে বুঝতে হলে চিত্র-৬ খেয়াল করতে হবে। চিত্র-৬ক তে আমরা ৪ একক বাহুবিশিষ্ট (অর্থাৎ বর্গের চারদিকে ৪টি করে গোল্লা আছে) বর্গ তথা ৪ এর বর্গ ৪২=১৬ দেখতে পাচ্ছি। এখন পরবর্তী বর্গ পেতে হলে আমাদেরকে উপরে এবং ডানে আরও কিছু গোল্লা দিতে হবে (চিত্র-৫খ এর মত)। এখন উপরে কয়টি গোল্লা দিব, আর ডানে কয়টি দিব, তা আমরা যথাক্রমে চিত্র-৬খ ও চিত্র-৬গ তে দেখতে পাচ্ছি। স্বাভাবিকভাবেই উপরে চারটি এবং ডানে চারটি গোল্লা দিতে হবে। তাহলে, চিত্র-৬খ অনুসারে, উপরে ডান কোণায় একটি জায়গা ফাঁকা আছে, সেখানে আর একটি গোল্লা বসিয়ে দিলেই হয়ে গেল পরবর্তী বর্গ (চিত্র-৬ঘ)। এই বর্গটি হল ৫ একক বাহুবিশিষ্ট, অর্থাৎ ৫ এর বর্গ বা ৫২=২৫। তাহলে, ৪২ থেকে ৫২ পেতে আমাদেরকে ২ × ৪ + ১ = ৯টি গোল্লা যোগ করতে হয়েছে। অর্থাৎ ৪২ এর উপরে ৪টি, ডানে ৪টি (২ × ৪ = ৮), এবং ফাঁকা জায়গায় ১টি, মোট ৯ যোগ করতে হয়েছে।
অর্থাৎ ৪২ + ৯ = ৫২
বা, ৪২ + ৩২ = ৫২ যা একটি পীথাগোরাসের ত্রয়ী। এখানে যোগকৃত ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ একটি বর্গসংখ্যা।
তাহলে, ৫২ এর পরবর্তী বর্গ ৬২ পেতে হলে আমাদের কত যোগ করতে হবে? ৫২ এর উপরে ৫টি, ডানে ৫টি, আর ফাঁকা জায়গায় ১টি, মোট ২ × ৫ + ১ = ১১ যোগ করতে হবে (চিত্র-৭)। অর্থাৎ, ৫২ + ১১ = ৬২। কিন্তু এবার যোগকৃত ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ ১১ কিন্তু একটি পূর্ণ বর্গসংখ্যা নয়, সুতরাং এখান থেকে আমরা কোন পীথাগোরাসের ত্রয়ী পাচ্ছি না।
তাহলে পীথাগোরাসের কি আর কোন ত্রয়ী পাওয়া সম্ভব? পীথাগোরাসের ত্রয়ী পেতে হলে ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ কে হতে হবে বর্গ সংখ্যা। তাহলে বিজোড় বর্গ সংখ্যা আর কী কী আছে? ১, ৯, ২৫, ৪৯, ৮১, …… ইত্যাদি। এই বিজোড় বর্গসংখ্যাগুলোকে যখন আমরা যোগকৃত ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারব, তখনই আমরা পীথাগোরাসের ত্রয়ী পাব। উপরের ধারাবাহিকতা অনুসারে আমরা যদি একটি বর্গ থেকে পরবর্তী বর্গ পাওয়ার বিষয়টিকে সমীকরণ আকারে লিখি, তাহলে আমরা লিখতে পারি,
৩২ + (২ × ৩ + ১) = ৩২ + ৭ = ৪২
৪২ + (২ × ৪ + ১) = ৪২ + ৯ = ৫২
৫২ + (২ × ৫ + ১) = ৫২ + ১১ = ৬২
৬২ + (২ × ৬ + ১) = ৬২ + ১৩ = ৭২
৭২ + (২ × ৭ + ১) = ৭২ + ১৫ = ৮২
৮২ + (২ × ৮ + ১) = ৮২ + ১৭ = ৯২
৯২ + (২ × ৯ + ১) = ৯২ + ১৯ = ১০২
১০২ + (২ × ১০ + ১) = ১০২ + ২১ = ১১২
১১২ + (২ × ১১ + ১) = ১১২ + ২৩ = ১২২
১২২ + (২ × ১২ + ১) = ১২২ + ২৫ = ১৩২
শেষ লাইনে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ টি ২৫, যা একটি পূর্ণ বর্গসংখ্যা। ৯ এর পরবর্তী বর্গসংখ্যা ২৫ কে ‘উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা’ হিসেবে পেতে আমাদের অন্তত ১০ লাইন লিখতে হয়েছে। যার ফলে আমরা পেয়ে গেছি পরবর্তী পীথাগোরাসের ত্রয়ীঃ
১২২ + ২৫ = ১৩২
বা, ১২২ + ৫২ = ১৩২
কিন্তু এর পরবর্তী বিজোড় বর্গসংখ্যা ৪৯ পেতে আমাদের আরও অনেক লাইন লিখতে হবে। তা না করে আমরা উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যার যে সূত্রটা পেয়েছি, সেই সূত্র ব্যবহার করে খুব সহজেই ৪৯ এর সংশ্লিষ্ট পীথাগোরাসের ত্রয়ী পেয়ে যেতে পারি। কীভাবে? আমরা লিখতে পারি, ৪৯ = ২ × ২৪ + ১। তার মানে ২৪২ এর উপরে এবং ডানে যদি আমরা ২৪টা করে গোল দিই এবং ফাঁকা জায়গায় ১টা গোল দিই, তাহলেই আমরা পেয়ে যাব ২৫২ (চিত্র-৮)।
তাহলে, ২৪২ + ৪৯ = ২৫২ বা, ২৪২ + ৭২ = ২৫২ যা একটি পীথাগোরাসের ত্রয়ী।
একইভাবে, পরবর্তী পীথাগোরাসের ত্রয়ীর জন্য উপযুক্ত বিজোড় সংখ্যা হবে ৭২ = ৪৯ এর পরবর্তী বিজোড় বর্গ সংখ্যা, অর্থাৎ ৯২ = ৮১ যাকে আমরা লিখতে পারি, ৮১ = ২ × ৪০ + ১। তাহলে, আগের মতই ৪০২ এর উপরে এবং ডানে যদি আমরা ৪০টা করে গোল দিই এবং ফাঁকা জায়গায় ১টা গোল দিই, তাহলেই আমরা পেয়ে যাব ৪১২। অর্থাৎ,
৪০২ + ৯২ = ৪১২
তাহলে, পরবর্তী পীথাগোরাসের ত্রয়ীটা আশা করি আমরা নিজেরাই এখন বের করতে পারব। এখন সবার কাছে প্রশ্ন রইল, এরকম পীথাগোরাসের ত্রয়ী আরও কতগুলো পাওয়া সম্ভব?
একটা গোপন কথা বলে রাখি, পীথাগোরাসের অনেক আগেই কিন্তু ব্যবিলনীয়রা পীথাগোরাসের উপপাদ্যের ব্যবহার জানত, বিশেষ করে ৩,৪,৫ এর পীথাগোরাসের ত্রয়ী সম্পর্কে তারা খুব ভালভাবেই জানত, কিন্তু পীথাগোরাস সাহেবই প্রথম এ বিষয়টিকে গাণিতিক সূত্রে রূপ দেন বলেই এই উপপাদ্যটি পীথাগোরাসের উপপাদ্য নামে সমধিক পরিচিত।
একইভাবে, আমরাও যদি কোন বিষয়কে সুন্দরভাবে গাণিতিক সূত্রে রূপদান করতে পারি, সেটি আমাদের উপপাদ্য, আমাদের ত্রয়ী নামে পরিচিত হবে, তাই না!!!! তাহলে আর দেরি কেন, সূত্র বানানোর কাজে নেমে যাই সবাই।
মে-জুন ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ১
No Comment