পত্র-পত্রিকায় আমরা নিয়মিত পড়ি, অমুক দিন পৃথিবী তমুক ধূমকেতুর আঘাতে শেষ হয়ে যাবে। এ সবই সংবাদ-মাধ্যমগুলোর অতিরঞ্জন। তবে যা কিছু রটে, কিছু না কিছু ঘটে বলেই সামান্য কিছু সত্যতাও আছে। পৃথিবীর সাথে এমন সংঘর্ষের দিক থেকে গ্রহাণু ও ধূমকেতুদের কথাই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে।
সুইফট টাটল (Swift-Tuttle) এমন একটি ধূমকেতু। জানা গিয়েছিল, ২১২৬ সালের ২১শে আগস্ট এটি পৃথিবীতে আঘাত হানবে। যদি সেটাই ঘটে, বৈশ্বিক দুর্যোগ অবধারিত। ইতি ঘটবে মানুষেরও। ১৯৯৩ সালে একে দেখার পরে হিসাব-নিকাশ করে দেখা গেল ২১২৬ সালে একটি সংঘর্ষ হচ্ছেই।
পরে সংশোধিত হিসাবে দেখা যায়, এটি সপ্তাহের জন্যে পৃথিবীকে মিস করবে। অল্পের জন্য বাঁচা। আমরা এর দিক থেকে নিশ্চিন্তেই থাকতে পারি। তবে বিপদ যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। আজ হোক, কাল হোক, সুইফট টাটল বা এরই মতো কেউ পৃথিবীতে আঘাত হানবেই।
চিত্র-১: সুইফট টাটল ধূমকেতু
হিসাবে দেখা গেছে, অর্ধ-কিলোমিটার বা তারও বেশি চওড়া দশ হাজার বস্তুর কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের ওপর দিয়ে গেছে। বিশাল বিশাল এই উপদ্রবগুলোর জন্ম সৌরজগতের বহিঃস্থ শীতল এলাকায়। কিছু কিছু হলো ধূমকেতুর ধ্বংসাবশেষ। আটকা পড়ে আছে গ্রহদের মহাকর্ষীয় বাঁধনে।
অন্যদের উৎপত্তি গ্রহাণু বেষ্টনিতে (asteroid belt)। জায়গাটা মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝখানে। কক্ষপথের ভারসাম্যহীনতার কারণে এরা নিয়মিত সৌরজগতে আসা-যাওয়া করছে। আকারে ছোট হলেও এদের প্রতিক্রিয়া ভয়ংকর। পৃথিবী ও অন্য গ্রহদের স্থায়ী বিপদের কারণ।
এ বস্তুগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই পৃথিবীর সবগুলো নিউক্লিয়ার অস্ত্রের চেয়েও বেশি ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম। যে-কোনো সময় কোনো একটি আঘাত হানতে পারে। সেটা মানুষের জন্যে একটি খারাপ খবরই হবে। সেটা হবে মানব ইতিহাসের একটি আকস্মিক ও নজিরবিহীন প্রতিবন্ধক।
কিন্তু পৃথিবীর ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা মোটামুটি নিয়ম মেনে চলে। ধূমকেতু বা গুহাণুর এ মাত্রার সংঘর্ষ গড়ে কয়েক মিলিয়ন বছরে একবার ঘটে। অনেকের বিশ্বাস, এ ধরনের এক বা একাধিক ঘটনার ফলেই সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পরের বার হয়ত আমাদের পালা।
চিত্র-২: গ্রহাণু বেষ্টনি
অবশ্যই পৃথিবী আরও নানা রকম প্রতিকূল ঘটনার শিকার হতে পারে। বিপুল পরিমাণ বলের বাঁধনে পরিব্যপ্ত মহাবিশ্বের পুঁচকে একটি বস্তু এই পৃথিবী। এত কিছুর পরেও অন্তত সাড়ে তিনশো কোটি বছর ধরে আমাদের গ্রহটি প্রাণ ধারণের উপযোগী হিসেবেই আছে।
তবে গ্রহটিতে আমাদের সাফল্যের পেছনে রহস্য কিন্তু মহাকাশই। অনেকভাবেই। বিশাল শূন্যতার মহাসাগরে আমাদের সৌরজগত ক্ষুদ্র একটি সক্রিয় অঞ্চল। আমাদের নিকটতম নক্ষত্রের (সূর্যের পরে) অবস্থান চার আলোকবর্ষ দূরে। এই দূরত্ব কত বেশি সেটা বুঝতে হলে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
সূর্য থেকে মাত্র সাড়ে আট মিনিটের মধ্যে আলো নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল পথ পেরিয়ে আসে। চার বছরে অতিক্রম করে ২০ ট্রিলিয়ন (২০ লক্ষ কোটি) মাইলেরও বেশি পথ। সূর্য একটি আদর্শ বামন নক্ষত্র। অবস্থান আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের (milky way galaxy) একটি আদর্শ অঞ্চলে।
এ ছায়াপথে নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার কোটি। কারও ভর সূর্যের কয়েক শতাংশ। কারও কারও ভর আবার সূর্যের একশো গুণ। এরা ধীরে ধীরে ছায়াপথের কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরছে। ঘুরছে ছায়াপথে থাকা প্রচুর পরিমাণ গ্যাসীয় মেঘ ও ধুলো, অজানা সংখ্যক ধূমকেতু ও গ্রহাণু, গ্রহ এবং কৃষ্ণগহ্বরও।
এই বিপুল পরিমাণ বস্তুর উপস্থিতির কথা শুনে মনে হতে পারে, ছায়াপথটি বুঝি বিভিন্ন বস্তু দিয়ে কানায় কানায় ভর্তি। এ ধারণা ভুল। আসলে, ছায়াপথটির দৃশ্যমান অংশ প্রায় এক লাখ আলোকবর্ষ পরিমাণ চওড়া। আকৃতি হলো থালার মতো। কেন্দ্রীয় অংশটা একটু স্ফীত।
একে ঘিরে ছড়িয়ে আছে কয়েকটি সর্পিল বাহু। বাহুগলো গড়া নক্ষত্র ও গ্যাসীয় পদার্থ দ্বারা। এমনই একটি সর্পিল বাহুতে রয়েছে আমাদের সূর্য। কেন্দ্র থেকে এটি আছে প্রায় ত্রিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে।
চিত্র-৩: আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গা
আমরা যতদূর জানি, আকাশগঙ্গা ছায়াপথে খুব ব্যতিক্রমধর্মী কিছুই নেই। একই রকম আরেকটি ছায়াপথ হলো অ্যান্ড্রোমিডা। এটি আছে আমাদের থেকে বিশ লাখ আলোকবর্ষ দূরে। আকাশের অ্যান্ড্রোমিডা তারামণ্ডলের দিকে এর অবস্থান। খালি চোখে একে ঝাপসা ছোপ ছোপ আলোর মতো মনে হয়।
বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র সাজিয়ে রেখেছে আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব। কোনোটি সর্পিল, কোনোটি উপবৃত্তাকার, কোনোটি আবার নির্দিষ্ট আকারহীন। দূরত্বের মাপাকাঠি এখানে বিশাল। শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে কয়েক বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের ছায়াপথও আলাদাভাবে দেখা সম্ভব।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো এদের আলো আমাদের কাছে পৌঁছতেই পৃথিবীর বয়সের (সাড়ে চারশো কোটি বছর) চেয়ে বেশি সময় লেগে গেছে। এই বিশাল স্থানের উপস্থিতির অর্থ হলো মহাকাশে সংঘর্ষের ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিপদ লুকিয়ে আছে এর আশেপাশেই।
গ্রহাণুদের কক্ষপথ সাধারণত পৃথিবীর কাছাকাছি থাকে না। এদের বড় অংশই মঙ্গল বৃহস্পতির মাঝখানে গ্রহাণু বেষ্টনিতেই থাকে সব সময়। তবে বৃহস্পতির বিপুল ভর গ্রহাণুদেরকে কক্ষপথ থেকে ছিটকে দিতে পারে। ফলে এদের কোনো কোনোটি সূর্যের দিকে চলে আসে। ডেকে আনে পৃথিবীর বিপদ।
আরেকটি বিপদ হলো ধূমকেতু। মনে করা হয়, দর্শনীয় এ বস্তুগলোর উৎপত্তি সূর্য থেকে প্রায় এক আলোকবর্ষ দূরের একটি মেঘপুঞ্জে। এখানে দোষ বৃহস্পতির নয়। দায়ী বরং নিকটস্থ নক্ষত্ররা। ছায়াপথ স্থির বসে নেই। শুধু নক্ষত্রগুলোই ছায়াপথ কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে না, ছায়াপথ নিজেও ধীরে ধীরে আবর্তন করছে।
সূর্য তার সঙ্গী গ্রহদেরকে নিয়ে প্রায় ২০ কোটি বছরে ছায়াপথকে পুরো একবার ঘুরে আসে। এ যাত্রাপথে মুখোমুখি হতে হয় নানা রকম অভিজ্ঞতার। নিকটবর্তী নক্ষত্ররা ধূমকেতুর মেঘকে নাড়িয়ে দিতে পারে। কিছু কিছু ধূমকেতু তখন ছিটকে আসবে সূর্যের দিকে।
ধূমকেতুরা সৌরজগতের ভেতরের দিকে চলে এলে সূর্যের উত্তাপে এদের উদ্বায়ী পদার্থ বাষ্পীভূত হয়ে যায়। সৌর বায়ুর ধাক্কায় একটি লম্বা প্রবাহ তৈরি হয়। এটাই ধূমকেতুর বিখ্যাত লেজ। সৌরজগতের ভেতরের দিকে চলে এলেও ধূমকেতুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ হবার সম্ভাবনা খুব কম।
তবে ক্ষতি ধূমকেতুও করে। তবে তার দোষ কিন্তু পড়ে পথে দেখা হওয়া নক্ষত্রের ওপর। তবে আমাদের ভাগ্য ভাল যে নক্ষত্রের মাঝের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে না।
চিত্র-৪: সৌরবায়ু
ছায়াপথের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে আরও কিছু বস্তু আমাদের দিকে চলে আসতে পারে। যেমন ছায়াপথে ভেসে চলা গ্যাসের বড় বড় মেঘপুঞ্জ। এরা প্রচণ্ড চিকন হলেও সৌরবায়ুকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। প্রভাবিত করতে পারে সূর্য থেকে আসা তাপের প্রবাহকে।
অন্ধকার মহাশূন্যে আরও নানান ভয়নাক জিনিস লুকিয়ে থাকতে পারে। যেমন, বিচ্ছিন্ন গ্রহ, নিউট্রন নক্ষত্র, বাদামি বামন, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি। এরা সহ আরও অনেকেই অজান্তে আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে পারে। সৌরজগতে ঘটে যেতে পারে টালমাটাল অবস্থা।
বিপদ আরও ভয়াবহও হতে পারে। কোনো কোনো জ্যোতির্বিদ মনে করেন, সূর্য হয়ত একটি দ্বি-তারা জগতের অংশ। আমাদের ছায়াপথের আরও বহু নক্ষত্রের অবস্থাই এমন। সূর্যের প্রস্তাবিত এই সঙ্গী তারাটির নাম নেমেসিস। যদি আসলেই থেকে থাকে, তবুও এটি অনেক বেশি অনুজ্জ্বল। দূরত্ব অনেক বেশি।
এজন্যই এখনও একে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে এর গতি ধীর হলেও মহাকর্ষের মাধ্যমে এটি উপস্থিতির জানান দিতে পারে। মাঝে মাঝে দূরের ধূমকেতুদের গতিপথ পাল্টে পাঠিয়ে দিতে পারে পৃথিবীর দিকে। পরিণতিতে ঘটবে একের পর এক সাংঘাতিক সংঘর্ষ।
ভূতাত্ত্বিকেরা দেখেছেন যে, নিয়মিত বিরতিতে বড় আকারের বাস্তগত (ecological) বিপর্যর ঘটে। এটা ঘটে প্রতি ৩০ লাখ বছর পরে একবার। আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে জ্যোতির্বিদরা জানলেন, সম্পূর্ণ ছায়াপথেরই সংঘর্ষ বাঁধাতে পারে। আকাশগঙ্গার সাথে আরেকটি ছায়াপথের ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা কেমন?
এমন কিছু প্রমাণ অবশ্য আছে। নক্ষত্রদের দ্রত চলাচল দেখে বোঝা যায়, ইতোমধ্যে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ নিকটস্থ ছায়াপথদের সাথে সংঘর্ষ করে নড়েচড়ে বসেছে। তবে নিকটস্থ দুটো ছায়াপথের সংঘর্ষ বাঁধলেই যে ছায়াপথ পরিবারের নক্ষত্রদেরও বিপর্যয় ঘটবে এমন কোনো কথা নেই।
ছায়াপথদের ঘনত্ব এত কম যে নক্ষত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ না ঘটিয়েও এরা একে অন্যের সাথে মিশে যেতে পারে।
চিত্র-৫: অ্যান্ড্রোমিডা-আকাশগঙ্গা সংঘর্ষ
মহাপ্রলয়ের আলোচনা অধিকাংশ মানুষকে মুগ্ধ করে। তাঁদের কাছে মহাপ্রলয় মানে আকস্মিক ও দৃষ্টিকাড়া উপায়ে পৃথিবীর মৃত্যু। তবে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাওয়ার চেয়ে হঠাৎ মৃত্যুর মধ্যেই বিপদ কম। অনেকগুলো উপায়ে পৃথিবী ধীরে ধীরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে।
যেমন, বাস্তুসংস্থানের ক্রমানবনতি, জলবায়ু পরিবর্তন বা সূর্য থেকে আসা তাপের পরিমাণের একটুখানি তারতম্য। ভঙ্গুর পৃথিবীতে এগুলো আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে না ফেললেও আরাম-আয়েশের জীবনে ইতি অবশ্যই ঘটাবে। তবে এ ধরনের পরিবর্তন ঘটতে হাজার হাজার বা এমনকি লক্ষ লক্ষ বছরও লেগে যায়।
আধুনিক প্রযক্তির সাহায্যে মানুষ হয়ত এগুলোকে প্রতিরোধও করতে পারবে। যেমন, নতুন করে ধীরে ধীরে বরফ যুগের সূচনা হতে থাকলেও আমাদের সম্পূর্ণ বিপর্যয় ঘটবে না। সেটা ঘটার আগে সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজাবার জন্যে যথেষ্ট সময় হাতে থাকবে আমাদের।
ধরে নেওয়া যায় যে একবিংশ শতাব্দীতেও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটতে থাকবে। ফলে এটা বিশ্বাসযোগ্য যে মানুষ বা তার বংশধররা ক্রমেই জগতের বড় কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। ঠেকাতে পারবে বড় বড় সব দুর্যোগও।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৯। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৫
No Comment