।মাহমুদুল হাসান জাবির।
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে শ্বসন প্রক্রিয়া। আর এই প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় শ্বসনতন্ত্র দ্বারা। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস শব্দ দুটোয় নিশ্চয়ই তোমরা গুলিয়ে ফেলো? হ্যাঁ, অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। ব্যাপারটা হচ্ছে, আমরা প্রশ্বাস গ্রহণ করি আর নিঃশ্বাস ত্যাগ করি; নিই না।
তোমরা নিশ্চিয়ই জানো যে, আমরা যখন প্রশ্বাসের সাথে O2 (অক্সিজেন) গ্রহণ করি, তখন ওই গ্যাস আমাদের পুরো দেহে ঘুরে আসে। আমরা সে বিষয়েই আলোচনা করবো।
প্রথমেই আমাদের এই একমাত্র অবলম্বন অক্সিজেন নামক গ্যাসটি সম্বন্ধে ধারণা নিই। এই গ্যাসটি মূলত যুক্তরাজ্যের একজন বিজ্ঞানী জোসেফ প্রিস্টলি ১৭৭৪ সালে আবিষ্কার করেন। এই গ্যাসের পারমাণবিক সংখ্যা হচ্ছে ৮। আর পারমাণবিক ভর হচ্ছে ১৬। এটা আগুন জ্বালানোর একমাত্র অবলম্বন।
অক্সিজেনের উৎপত্তিস্থল হলো গাছ। যা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রকৃতি আমাদের এই গ্যাসটি এত বেশি সরবরাহ করে যে, একজন মানুষ প্রতিদিন ৬০০ লিটার অক্সিজেন প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করার পরেও প্রকৃতিতে এর ভারসাম্যতা বজায় থাকছে।
যখন তুমি শ্বাস গ্রহণ করো, তখন বুকে হাত দিয়ে দেখবে বক্ষ প্রসারিত হচ্ছে। তখন তোমার বক্ষের নিচে মধ্যচ্ছদা বা ডায়াফ্রাম ছোট হয়ে গিয়ে নিচের দিকে নেমে যায়। এর ফলেই তোমার বক্ষ প্রসারিত হয়। এটা হয় তোমার শ্বাস নিতে স্নায়বিক উত্তেজনার কারণে। আবার যখন শ্বাস ত্যাগ করো, তখন মধ্যচ্ছদা বা ডায়াফ্রাম প্রসারিত হয়ে যায়। যার ফলে আবার তোমার বক্ষ সংকুচিত হয়।
এবার চলো আমরা অক্সিজেনের বাড়ি যাই। যখন আমরা প্রশ্বাস গ্রহণ করি, তখন অক্সিজেন (O2) প্রথমে আমাদের ফুসফুসে যায়। তারপর ফুসফুসের অ্যালভিওলাসে চলে যায়। অ্যালভিওলাস হচ্ছে বায়ুকোষ বা বায়ুথলি। এই বায়ুথলিগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুক্লোম শাখাপ্রান্তে মৌচাকের মতো থাকে। এগুলোর আবরণী এতই পাতলা যে, এর ভেতর দিয়ে বায়ু আদান-প্রদান হয়। এসব থলির উপরিভাগ কৈশিক নালিকা দ্বারা পরিবেষ্টিত। যখন তুমি শ্বাস নিচ্ছো, তখন এগুলো বেলুনের মতো ফুলে উঠছে। অ্যালভিওলাসে যাওয়ার পর অক্সিজেন ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে।
রক্তের ধরনগুলো নিশ্চয়ই তোমরা জানো? সেগুলো হচ্ছে ১) লোহিত রক্তকণিকা ২) শ্বেত রক্তকণিকা ৩) অনুচক্রিকা।
এখানে অক্সিজেন শুধু লোহিত রক্তকণিকার সাথে বিক্রিয়া ঘটায়। লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিন নামক একটি রঞ্জক থাকে। হিমোগ্লোবিন এর হিম গ্রুপের সাথে ৯৭% অক্সিজেন বিক্রিয়া করে অক্সিহিমোগ্লোবিন তৈরি করে। আর ৩% অক্সিজেন ভৌত দ্রবণ রূপে রক্তরসে দ্রবণ তৈরি করে। তারপর সেটা কোষে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে।
অর্থাৎ লসিকায় প্রবেশ করে। অন্যভাবে বলতে পারো রক্তরস বা কলারসে প্রবেশ করে। তারপর কোষে খাদ্যবস্তুর সাথে বিক্রিয়া করে শক্তি (ATP) উৎপন্ন করে। এই শক্তি জমা থাকে। প্রয়োজনে শরীর এই শক্তি কাজে লাগায়।
কোষে প্রবেশ করার পর অক্সিজেনের বিক্রিয়ার ফলে CO2 গ্যাসটিও উৎপাদন করে। অর্থাৎ কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে।অতঃপর আবার সেটা ব্যাপন প্রক্রিয়ায় রক্তে ফিরে আসে। রক্তে এসে হিমোগ্লোবিন এর হিম গ্রুপের সাথে মিশে কার্বমিনো হিমোগ্লোবিন-এ পরিণত হয় ২৩% কার্বন-ডাই-অক্সাইড। আরো ৭% কার্বন-ডাই-অক্সাইড রক্তরসের সাথে দ্রবণ তৈরি করে।
বাকি ৭০% বাই কার্বনেট রুপে রক্তে পানির সাথে মিশে কার্বনিক এসিড তৈরি করে। এবার রক্তে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই অ্যালভিওলাসে এসে ঢুকে পড়ে। তারপর ফুসফুস হয়ে নিঃশ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে বাহিরের পরিবেশে ত্যাগ করে।
তাহলে তোমরা নিশ্চিয়ই ভাবতে পারো যে, এতগুলো কার্যক্রম নিজে নিজেই কিভাবে হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এর নিয়ন্ত্রণের জন্য মস্তিষ্কে কিছু কেন্দ্র আছে। এমনকি যখন তুমি ঘুমাও, তখন তো নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চলতে থাকে। তখন মস্তিষ্কে এই কেন্দ্রগুলো কাজ করে। সেগুলো হচ্ছে মেডুলা এবং পনস। এই দুইটা অংশ মস্তিষ্কের পশ্চাৎ ভাগে থাকে। মস্তিষ্কের আলোচনায় তোমরা এসব বিস্তারিত পাবে।
তাহলে যখন তোমার দেহে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ বেড়ে যায়। তখনই কিছু রিসেপ্টর মস্তিষ্কে খবর পাঠায়। তখনি মস্তিষ্ক ডায়াফ্রামের সংকোচন-প্রসারণ ঘটায়। যার কারণে তোমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চলতে থাকে। পনস এ দুটি কেন্দ্র থাকে। একটি হচ্ছে নিউমোট্রাক্সিক। যা নিঃশ্বাস ঘটায়। আরেকটি হচ্ছে অ্যপনিইস্টিক। যা প্রশ্বাস ঘটায় এবং এর হার নির্ণয় করে।
জেনে রাখো, অক্সিজেনটা কিন্তু তোমার পুরো দেহের রক্তে ঘুরে আসে। অর্থাৎ ঠিক এই মুহূর্তে যেই শ্বাস গ্রহণ করলে এবং কয়েক সেকেন্ড পর আবার শ্বাস ত্যাগ করছো। এরই মধ্যে এতো কিছু ঘটে গেলো। অবাক করা বিষয়!
একটা মজার তথ্য কি জানো? এক মিনিটে একটা বাচ্চা ৪০ বার এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ১২-১৬ বার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চালায়। আর ভাবো.. এতোসব কার্যক্রম তোমার ভেতরে প্রতি মিনিটে কতোবার করে হয়। আশ্চর্য না?
আরেকটা মজার তথ্য তোমাদের সাথে শেয়ার করি। সেটা হচ্ছে, আমাদের মস্তিষ্ক দেহের তুলনায় এতো ছোট হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণকৃত অক্সিজেনের ২০% মস্তিষ্ক ব্যবহার করে। ঠিক একইভাবে ২০% রক্ত মস্তিষ্ক আদান-প্রদান করে। আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছো? যখন তুমি খাবার খাও, তখন কিন্তু নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
আগামীতে আরেকটা টপিক নিয়ে তোমাদের নিকট হাজির হবো। ইন-শা-আল্লাহ। আজ এ পর্যন্তই।
জুলাই-আগস্ট ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ২
No Comment