।মাবরুর আহমাদ নাকীব।
প্রিয় স্বপ্নচারী বন্ধুরা, বলো দেখি ১৭৮৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী মার্টিন হাইনরিখ ক্ল্যাপের আবিষ্কার করা একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ যে রীতিমতো বিশ্ব ক্ষমতার মাপকাঠি হয়ে উঠবে— তা তখন কে জানতো! অথচ এই পদার্থই জ্ঞান নির্ভর বিশ্বকে এক অর্থে নিজের হাতে তুলে নিলো।
উলটপালট করে দিলো মহাকাল ধরে চলমান বিশ্বের গতিপথ। বিশ্ব দেয়ালবদ্ধ হয়ে গেলো পর্যায় সারণীর ৭ম পর্যায়ক্রমের ৩য় সারির B উপসারিতে জ্বলজ্বলে নীলাভ সফেদ পদার্থের।
হ্যাঁ, বলছি ইউরেনিয়ামের কথা। সিসার চেয়েও ৭০ শতাংশ বেশি ঘনত্বের এই মৌল— বর্তমান বিশ্বকে জিম্মি করে রেখেছে তার মহাবিধ্বংসী ক্ষমতার দাপটে। কথাটা বোধহয় একটু ভুল হয়ে গেলো— স্রষ্টা সকল পদার্থই সৃষ্টি করেছেন মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য।
আমরাই অপব্যবহারের শ্লোগানে তাকে বিধ্বংসী বানিয়ে নিয়েছি— নিজেদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগের জন্য। যা আমাদের জন্য ভীষণ অনুতাপের। যদিও মানুষ বুঝে না অথবা বুঝতে চায় না। প্রক্রিয়াজাতকৃত ইউরেনিয়াম মজুদে যে দেশ যত সমৃদ্ধ— বর্তমান ক্ষমতার হিসেবনিকেশে ততটা শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত।
ওই দেশগুলোরই যেন বাকি সব দেশের উপর খবরদারি করার অলিখিত ক্ষমতা পেয়ে বসে। বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির নিয়ন্তা সেজে কৌশলে শোষণ, নিগ্রহ আর কূটচালের মাধ্যমে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলে। ইউরেনিয়াম মজুদে অক্ষম বা ইচ্ছাকৃতভাবে অক্ষম করে রাখে দেশগুলোকে। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইসরাইল, পাকিস্তান, ভারত অন্যতম।
চিত্র ১: এক খণ্ড ইউরেনিয়াম
সে অনেক কথা। চলো আমরা আপাতত ইউরেনিয়ামের গতিপ্রকৃতির দিকে দৃষ্টি ফেরাই। বর্ণের দিক দিয়ে ইউরেনিয়াম রূপালী এবং সাদা। যা স্টিল থেকে খানিক নমনীয়। প্রকৃতিতে উন্মুক্ত অবস্থায় ইউরেনিয়াম পাওয়া গেলেও তা অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য।
তারচেয়ে বড় কথা হলো, একে প্রক্রিয়াজাত করা খুবই জটিল সমীকরণের ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবেই কোনকিছু যতো বড়ো ব্যাপার হয়— তাকে অর্জন করতে গেলে ততো বেশি প্রক্রিয়া সামলাতে হয়। বিজ্ঞানী ইউজিন ১৮৪১ সালে ইউরেনিয়াম টেট্রোক্লোরাইড থেকে ইউরেনিয়ামকে প্রথম আহরণ করতে সক্ষম হন।
আর ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল তেজস্ক্রিয়তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইউরেনিয়ামের সক্ষমতা সম্পর্কে জানান দেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ইউরেনিয়াম কণাকে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে উত্তেজিত করার পর— তা স্বাভাবিকভাবে সুস্থিত অবস্থায় ফিরতে সুদীর্ঘ বারোশো বছর সময় নেয়।
এবং মাধ্যম হিসেবে যে দণ্ড ব্যবহৃত হয়— তার লেগে যায় ৬০বছর! একবার ভেবে দেখো, তার শক্তি জিইয়ে রাখার ক্ষমতা কতোটা সুউচ্চমানের। তোমরা কি ইউরেনিয়ামের ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছো? তবে চলো একটা গল্প শুনাই। এক করুণ পরিণতির গল্প। এক শিউরে ওঠা ভয়াবহতার গল্প।
চিত্র-২: ইউরেনিয়াম টেট্রোক্লোরাইড থেকে ইউরেনিয়ামকে প্রথম আহরণ করা হয়
১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট। নবোদিত সূর্য ঝলমলে রোদ ছড়িয়ে দিচ্ছিল তার উদয়ের দেশে। শিশুরা খেলায় মেতে উঠেছিলো খিলখিল হাসির শব্দে। জনকোলাহল ধীরেধীরে কর্মব্যস্ত হয়ে উঠছিলো জীবনকে সুন্দর পরিপাটি করে সাজানোর জন্য।
কিন্তু তাদের কি জানা ছিলো— ঘড়ির কাঁটা ৮:১৫ মিনিটে পৌঁছালে আর কোন আয়োজনের প্রয়োজন থাকবে না! হঠাৎ করে হিরোশিমা শহরের আকাশে কালোবিন্দুর মতো একটি বিমান অথবা বিশ্ব ইতিহাসের সবচে ভয়ঙ্কর বস্তু এগিয়ে এলো। ঘাতক মার্কিনিরা যার নাম দিয়েছিলো এনোলা গে। মডেল বি টুয়েন্টি নাইন।
নিক্ষিপ্ত হলো মাত্র এগারো কেজি ওজনের পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’। সাথেসাথে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হলো আস্ত এক সমৃদ্ধ শহর। কিছু বুঝতে না বুঝতেই নিজেদের ক্ষয়ে পড়া চামড়া টানতে টানতে ঢলে পড়লো দেড় লক্ষাধিক বনী আদম। তাদের শরীর হয়ে গেলো চর্বির ঘাষের মতো।
এই মৃত্যু উপত্যকায় তখন মৃত্যু ছাড়া আর কোন শব্দের অস্তিত্ব রইলো না। অপরিসীম তেজস্ক্রিয়তার ফলে সকল কিছু এমন বিষাক্ত হলো যে— দীর্ঘ কয়েক দশকের জন্য সেখানকার মাটি পর্যাপ্ত উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো। মায়ের পেটের শিশু হয়ে গেলো পঙ্গু-বিকলাঙ্গ। শুধু তৎকালীন নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
উফফ্! ভাবতে পারো কতটা ভয়ানক। কতটা বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। তা ভাবনারও বহু অতীত। আর এই পারমাণবিক বোমার প্রধান উপাদান হলো ইউরেনিয়াম। বড় ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো— সেই লিটল বয়ের ক্ষমতার চেয়ে বর্তমানের হাইড্রোজেন বোমার ক্ষমতা ১,৬০০গুণ অধিক!
সুপার পাওয়ার অস্ত্রাগারে যার মজুদ শয়ে শয়ে বাড়াচ্ছে ক্ষমতাধর দেশগুলো। ভেবে দেখো, আমাদের প্রিয় পৃথিবী কতটা ভয়ানক হুমকির মধ্যে এগিয়ে চলছে। এখন তোমরা আমাকে থামিয়ে, গালে হাত দিয়ে, কপাল কুঁচকে অবিশ্বাসের সুরে আমাকে প্রশ্ন করতে পারো— ভাইয়া! মাত্র এগারো কেজি ওজনের একটা বস্তু কিভাবে আস্ত শহরকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে যথেষ্ট হলো? এটা কি গালগল্পের মতো শুনালো না?
বলছি এবার, ইউরেনিয়ামের আশ্চর্য ধর্ম হলো— তাকে যখন উত্তপ্ত করা হয়, তার বিস্তৃতি জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ তাকে যদি একটি দড়ি হিসেবে কল্পনা করো— তাহলে প্রথমে যদি তার দৈর্ঘ্য এক ফুট আকারের হয়— তাহলে উত্তপ্ত হওয়ার পর তার আয়তন ক্রমানুযায়ী দশ ফুট, একহাজার ফুট, দশ হাজার ফুট, এক লক্ষ ফুট এভাবে ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে।
আর চলতে থাকবে অবর্ণনীয় শক্তির ধ্বংসলীলা। যা একটি বিস্তৃর্ণ শহরকে ধ্বংস করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
ও হ্যাঁ! শেষমেশ একটা আশার কথা শুনাই তোমাদের। আমাদের মৌলভীবাজারের হাওড় অঞ্চলে উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়ামের সন্ধান আবিষ্কৃত হয়েছে। যা অন্য যে কোনো ইউরেনিয়ামের চেয়েও উন্নত। আমরা যদি তাকে আমাদের কাজে লাগানোর মতো উপযুক্ত করতে পারি— তাহলে বিদ্যুতের কোন সমস্যাই আমাদের আর থাকবে না।
চিত্র-৩: বাংলাদেশে ইউরেনিয়াম
কারণ ইউরেনিয়ামের উচ্চমার্গীয় শক্তি ব্যবহার করে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে— এককথায় তা সকল চাহিদা মিটাবার জন্য যথেষ্ট। যার ফলে উন্নত বিশ্বের কাতারে আরবি ঘোড়ার মতো লাফিয়ে পৌঁছে যেতে আমাদের বাঁধা নিতান্তই নগণ্য হয়ে যাবে।
কি আগামীর সূর্য সন্তানেরা! আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে স্বপ্নের মতো বড় করে তুলতে তোমরা কি অগ্রগামী হবে না? আরে! তোমরা না এগোলে, এগোবে কে? তোমরাই না বাংলাদেশ! তোমরাই না বীরশ্রেষ্ঠ!
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৯। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৫
No Comment