।মুশফিকুর রহমান।
বন্ধুরা, কেমন আছ? আশা করি ভাল আছ।
তোমরা নিশ্চয়ই জান, পশু শিকার, আগুন আবিষ্কার, কৃষি বিকাশ, স্থলপথে চলাচলের জন্য চাকা আবিষ্কার এবং জল পথে চলাচলের জন্য জলযান আবিষ্কার ইত্যাদির মাধ্যমে মানব সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। এসব উদ্ভাবন মানব জাতির সভ্যতা বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।
৫৫৫০ বছর আগে মানুষ বায়ুশক্তিকে পালতোলা নৌকায় ব্যবহার করা শুরু করে। এর কিছুদিন পর কৃষি উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ বায়ু দিয়ে জমিতে সেচ ও ফসল মাড়াইয়ের কাজ শুরু করে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিদ্যুৎ ব্যবহার ও এর সংরক্ষণের ফলে মানুষের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। ১৮৮৮ সালে চার্লস ফ্রান্সিস রুর্স (১৮৪৯- ১৯২৯) বায়ুর টারবাইন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেন। উনিশ শতকে শুরুর দিকে ডেনমার্কের পদার্থবিজ্ঞানী পল লা চউর (১৮৪৬-১৯০৮) বায়ুর ঘূর্ণনযন্ত্রের আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
মূলত প্রবাহমান বায়ুর গতি শক্তিকে (kinetic energy) টারবাইনের মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদন করা হয়। আগের পর্বে আমরা জলবিদ্যুৎ কিভাবে উৎপাদন হয় তা দেখেছি। ঠিক একই পদ্ধতিতেই বায়ুবিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। বায়ুর গতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেনারেটরের টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
এ ক্ষেত্রে বায়ু যখন টারবাইনের ব্লেডের মধ্যে দিয়ে যায় তখন বায়ুর গতিশক্তি ঐ ব্লেডগুলোকে ঘুরায়। আর ঐ ব্লেডগুলোর সাথে রোটর সংযুক্ত থাকে যা ব্লেডগুলোর ঘূর্ণনের ফলে সক্রিয় হয়। এই রোটর জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত থাকে যার ঘূর্ণনের ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
বায়ু দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এমন এলাকাকে নির্বাচন করা হয় য়েখানে বাতাসের গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৬ থেকে ৮ মিটার। চাহিদা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী টাওয়ার (মিনার) নির্মাণ করা হয়। এই টাওয়ারগুলোর উচ্চতা ১০০ ফুট এর বেশি হয়। এই টাওয়ারের উপরেই থাকে টারবাইন। যা বায়ু প্রবাহের সাথে সাথে ঘুরতে থাকে।
সাধারণত উৎপাদন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে টারবাইনের সাইজ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ছোট পরিসরে বাসা বাড়িতে ব্যবহারের জন্য ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করা হয়। এছাড়াও মধ্যম ও বড় পরিসরে বিভিন্ন ক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় ডিজাইন করা হয়।
চল বন্ধুরা, এবার টারবাইনের বিভিন্ন অংশ গুলোর সাথে পরিচিত হই।
চিত্র-২: উইন্ড টারবাইনের বিভিন্ন অংশ
- ভিত্তি
- বৈদ্যুতিক গ্রিডের সংযোগ
- টাওয়ার
- উপরে ওঠার সিঁড়ি
- বায়ু প্রবাহের অভিমুখ নিয়ন্ত্রণ
- বহিরাবরণ
- জেনারেটর
- বায়ুর গতিমাপক যন্ত্র
- গতি নিয়ন্ত্রক
- গিয়ার বক্স
- ব্লেড বা পাখা
- রোটর হাব
বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল কাজ হল টারবাইনের ব্লেড বা পাখা ঘুরানো। প্রবাহমান বায়ুর সর্বোচ্চ পরিমাণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্লেড বা পাখাগুলোকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। তোমরা নিশ্চয়ই ফ্যানের পাখা লক্ষ করেছ।
ফ্যানের পাখা যেমন নির্দিষ্ট অনুপাতে ঢালু থাকে, ঠিক একই ভাবে টারবাইনের ব্লেডগুলো ডিজাইন করা থাকে। যাতে বায়ু প্রবাহ থেকে সর্বোচ্চ ও সুষম শক্তি পাওয়া যায়। ব্লেডগুলো সাধারণত অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি হয়।
এই ব্লেডকে রোটরের সাথে মজবুত ভাবে হাব দ্বারা আটকিয়ে রাখা হয়। রোটরের ঘূর্ণনকে সুষম করা ও যান্ত্রিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি সরল যন্ত্র বা গিয়ারবক্স ব্যবহার করা হয়। ঝড়ো হাওয়ায় অতিরিক্ত গতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রোটরে এক ধরনের গতি নিয়ন্ত্রক বা ব্রেক ব্যবহার করা হয়।
বায়ুর গতি ও দিক বোঝার জন্য বায়ুর গতি পরিমাপক যন্ত্র বসানো থাকে। কোন সময় বায়ুর দিক পরিবর্তন হলে তা এর মাধ্যমে বুঝতে পারা যায়। বায়ুর প্রবাহের দিকে টারবাইনকে ঘুরানোর জন্য এক প্রকার গিয়ার ব্যবহার করা হয়।
বাতাস প্রবাহের কারণে ব্লেড ঘোরার সাথে সাথে রোটরের সাথে কাপলিং করা জেনারেটর ঘুরতে থাকে। নির্দিষ্ট গতিতে ঘোরা শুরু হলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। যা ক্যাবলের মাধ্যমে একাধিক টারবাইন থেকে একটি কমন সংযোগে একত্রিত করে ব্যবহারের জন্য প্রেরণ করা হয়।
টারবাইনের ব্লেডগুলো আকার সাধারণত এর উৎপাদন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে হয়। ১৫ থেকে ৫০ মিটার বা তারও বেশি বড় হয়ে থাকে।
চিত্র-৩: উইন্ড টারবাইনের গঠন
বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন:
চীন বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। তারা বছরে প্রায় ১৬৮,৬৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তারা ১৫৩,৭৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে (২০১৬ সালের হিসেবে) । এছাড়াও জার্মানি, স্পেন ও ভারত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এগিয়ে আছে।
পৃথিবীতে প্রায় একষট্টির বেশি দেশ বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বাংলাদেশে ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও এই উৎসের ততটা সদ্ব্যবহার করতে পারেনি৷ বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় ফেনীর সমুদ্র উপকূলীয় সোনাগাজীতে অবস্থিত মুহুরী প্রজেক্টে।
ফেনীর মুহুরী নদীর তীর ঘেঁষে খোয়াজের লামছি মৌজায় ছয় একর জমির উপর এটি স্থাপিত। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র মুহুরী প্রজেক্ট একটি পাইলট (পরিক্ষামূলক) প্রকল্প হিসেবে চালু হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অবস্থিত ৪ টি ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন টারবাইন দিয়ে প্রায় এক মেগাওয়াট (০.৯ MW) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
চিত্র-৪: মুহুরী প্রজেক্ট
বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে ২০১২ সালে রিজেন পাওয়ারটেক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি একটি গবেষণা করে৷ গবেষকেরা ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কুয়াকাটা ও পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় বাতাসের গতি মাপেন।
তারা কক্সবাজার অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৬ থেকে ৮ মিটার পান। যেটা বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের উপযোগী৷ ২০১৭ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায় ১ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বায়ু চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হয়।
২০ কিলোওয়াট ক্ষমতার ৫০টি টারবাইন দ্বারা ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত নয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আশেপাশের প্রায় ৫৫০ গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
সমুদ্র সৈকতের দক্ষিণে আলী আকবরের ডেল এলাকায় বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অবস্থিত। গত বছরে বায়ুবিদ্যুৎ থেকে উৎপাদনের পরিমাণ ২.৯০ মেগাওয়াট।
বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সুবিধা এর কম খরচ। রক্ষণাবেক্ষন ও ব্যবহারও সহজ। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে যেকোন স্থানে বায়ুবিদ্যুৎ স্থাপন করা সম্ভব। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে ছোট খামার বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটি বেশ কার্যকরী।
বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বায়ুবিদ্যুৎ স্থাপন করে জাতীয় গ্রীডে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যুৎ যোগ করা সম্ভব।
বন্ধুরা, আজ এ পর্যন্তই। ভাল থেক, আবার দেখা হবে।
মে-জুন ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ১
No Comment