।মোঃ মোখলেছুর রহমান।
[পর্ব : ০২]
গত পর্ব যারা পড়েছ, রাজকীয় পতঙ্গের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। আর রাস্তায় বা গাছে উঠা শামুক এবং কিলিফিসকে তো ভুলবার নয়। সবই কিন্তু স্রষ্টার দেয়া নিয়ম। এভাবেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে জীবজগৎ যুগযুগ ধরে চলে আসছে। আমরা হয়ত এসব চিন্তাই করি না।
যাই হোক আমরা আজ নতুন কিছু জানব। আশা করি ভালই লাগবে। আর গত সংখ্যার ধারাবাহিকতায় আজকের আয়োজন।
ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ছোট প্রাণী দিয়ে শুরু করা যাক কেমন! তোমরা হয়ত সকলে জান, “পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে।” তবে পিপীলিকার পাখা নিয়ে অনেক জানার আছে। এটা নিয়ে পরের কোন সংখ্যায় বিশদভাবে জানব। পিঁপড়া প্রায় প্রতিদিনেই কোন না কোনভাবে আমাদের চোখে পড়ে।
এই পিঁপড়া যখন নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনে, কেমন লাগে বল তো! তাহলে এখন দেখি পিঁপড়ার মস্তিষ্ককে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যার দরুন পিঁপড়া নিজে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। যাই হোক পিঁপড়ার অকাল মৃত্যুর জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে ডিক্রসেলিয়াম ডেনড্রিটিকাম (Dicrocoelium dendriticum) নামক পরজীবী।
চিত্র-১: ডিক্রসেলিয়াম ডেনড্রিটিকাম
এই পরজীবী সাধারণত গরু, মহিষ, ভেড়া বা ছাগলের উদরে বসবাস করে। এদের ডিম ঐসব প্রাণীর বিষ্ঠার সাথে বেরিয়ে আসে। একসময় বিষ্ঠামিশ্রিত ডিম পানিতে চলে যায়। যা শামুক প্রিয় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। পরজীবীর ডিম কয়েকটি ধাপে স্পোরে পরিণত হয়।
এরা শামুকের কানেক্টিভ টিস্যুকে কাজে লাগিয়ে জাইগোট সম্পূর্ণ করে। শামুক ডাঙ্গায় উঠে বিষ্ঠার সাথে ফিমেল স্পোর বের করে দেয়। পিঁপড়া এসব স্পোর খেলেই পরজীবীরা মূল কাজ শুরু করে। স্পোরগুলো থেকে নিঃসৃত হয় একধরনের রাসায়নিক পদার্থ।
এবং এর ধারাবাহিকতায় এরা পিঁপড়ার মস্তিষ্ক দখল করে নেয়। পরজীবী তার জীবনচক্র পরিপূর্ণ করার জন্য পিঁপড়াকে সবুজ ঘাসের ডগায় নিয়ে যায়।
চিত্র-২: সবুজ ঘাসে চতুষ্পদ জন্তুর অপেক্ষারত পিঁপড়া
এবং গরু, মহিষ, ভেড়া বা ছাগলের জন্য অপেক্ষা করে। যার ফলশ্রুতিতে ঘাসের সাথে পিঁপড়া এসব প্রাণীর খাবার হিসাবে উদরে প্রবেশ করে এবং আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিতে বাধ্য হয়। কি আজব, তাই না! প্রকৃতির এসব ঘটনা কিন্তু নিয়মিত হচ্ছে তার খবর আমরা কজনই বা জানি।
চিত্র-৩: পরজীবীর জীবনচক্র
এখন একটি ছোট গল্প বলি। ঠিক মস্তিষ্ক দখল না হলেও এটা এর কাছাকাছি। মনে কর, তোমার জিহ্বা কেউ দখল করে ফেলল। কেমন লাগবে বল তো! পৃথিবীতে কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনাও ঘটে।
সাইমুথুয়া এক্সিগুয়া (Cymothoa exigua) নামক প্রাণী প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু মাছের জিহ্বায় বসবাস করে। এরা প্রথমে মাছের জিহ্বায় স্পোর হিসাবে বাসা বাঁধে। সেখানেই হয় প্রজনন। প্রথমে মাছের রক্ত শুষে নিতে শুরু করে। পরে আস্তে আস্তে মাছের জিহ্বাকে খেয়ে ফেলে; পূর্ণবয়ষ্ক হয়। নিজেরাই আবার সেখানে যুক্ত হয়।
চিত্র-৪: সাইমুথুয়া এক্সিগুয়াযুক্ত সামুদ্রিক মাছ
অর্থাৎ ঐ মাছের আর নিজের জিহ্বা থাকে না। এসব প্রাণী ঐ মাছের জিহ্বা হিসেবে কাজ করে। মনে হয় এটা প্রাকৃতিক জিহ্বা। আশ্চর্যের বিষয় হলো এসব প্রাণীদের দেখতে কিছুটা উকুনের মতো লাগে।
আর এরা সাধারণত মাছের খাবারকে হজম করার জন্য এক ধরনের এনজাইম নিঃসরণ করে। ঐসব মাছের রক্তে তাদের বিশেষ রাসয়নিক পদার্থ মিশে যায়। এভাবে এরা মাছের মস্তিষ্কের কিছুটা দখলে নেয়। মাছগুলো তাদেরই পছন্দমত খাবার গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
সেই সাথে মাছগুলো তাদের স্বাভবিক নিয়মের থেকেও বেশি ডিম দেয়। এভাবে বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কেমন সাংঘাতিক ব্যাপার, তাই না?
চিত্র-৫: সাদা বকের ব্যাঙ শিকার
আমরা সাদা বক দেখতে অনেক ভালবাসি। এক সংগে উড়াল দিলে তো মনে হয় যেন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। তো এখন দেখি বক এবং অন্যান্য পাখি কীভাবে ব্যাঙ শিকার করে।
রিবরোইয়া অন্ডেট্রে (Ribeiroia ondatrea) নামক পরজীবীর স্পার্ম সাধারণত পানিতে ভাসমান অবস্থায় থাকতে পারে। এসব স্পার্ম ব্যাঙাচি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে নিশ্চিতভাবে বক বা যে কোন পাখির শিকারে পরিণত হয়।
স্পার্মগুলো ব্যাঙাচি থেকে পরিপূর্ণ ব্যাঙে পরিণত হওয়ার বিস্তৃত সময়ে বংশবৃদ্ধি করে। এবং ব্যাঙাচির মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণসহ পুরো শরীর দখল করে নেয়। এরা দেখতে স্বাভাবিক ব্যাঙ থেকে আলাদা। পা সংখ্যায় অনেক বেশি। তবে লেজ ব্যাঙাচির ন্যায় থেকে যায়।
চিত্র-৬: পরজীবী নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ
এই জাতীয় ব্যাঙ বক বা পাখির কাছাকাছি আসতে বাধ্য হয়। নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করে ফেলে। সহজেই বক বা পাখির খাদ্যে পরিণত হয়। এ জাতীয় পরজীবী বক বা পাখির উদরে কিছুটা বিস্তার লাভ করে। একসময় পাখির বিষ্ঠার সাথে পানিতে মিশ্রিত হয়।
এভাবে চক্রাকারে পরজীবীর জীবন চক্র চলতে থাকে। এদের সাধারণত আমাজন জঙ্গলের কিছু কিছু নদীতে দেখা যায়। এভাবে একটি ব্যাঙের স্বাভাবিক গঠনকে এরা বাধা দেয় এবং আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। কি অদ্ভুত আর ভয়ঙ্কর তাই না!
টম আর জেরির কার্টুন ভালবাসে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই ইঁদুর-বিড়ালও মস্তিষ্ক দখল থেকে রেহাই পায়নি। আমরা ছোট থেকে কিন্তু জেনে এসেছি ইঁদুর বিড়ালকে অনেক ভয় পায়। আর বিড়াল ইঁদুরকে খেয়ে ফেলে। আবার অনেকেই মনে করে বিড়াল পরিবেশ সচেতন। কারণ বিড়াল নিজের বিষ্ঠা নিজেই মাটি চাপা দেয়।
আজকে জানব বিড়ালের পরিবেশ সচেতনতা আর ইঁদুরের আত্মহত্যা কাহিনী। টকএক্সোপ্লাজমা গন্ডি (Toxoplasma gondii) নামক পরজীবী ইঁদুরের মস্তিষ্ক দখল করে। সকল ভয়কেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মনে করো ইঁদুরের ভিতর কোনো ভয় নাই তাহলে কী হবে ভাব তো একবার। এই ক্ষুদ্র পরজীবী দেখতে সুন্দর হলেও এরা একেকটা প্রাণীর জীবন মরণ নির্ধারণ করে।
চিত্র-৭: ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে টকএক্সোপ্লাসমা গন্ডি পরজীবীর গঠন
প্রথমে মনে হবে তারা মনে হয় বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। কিন্তু না! মূলত পরজীবী ইঁদুরের পুরো মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে বিড়ালের নখ বা শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে পরজীবী একধরনের সুগন্ধ নিঃসৃত করে। এই গন্ধ ইঁদুরকে অনেক আকৃষ্ট করে।
তবে স্বাভাবিক কোনো ইঁদুর এই গন্ধে আকৃষ্ট হয় না। নিয়ন্ত্রিত কিছু ইঁদুর এই গন্ধে মাতাল হয়। সকল ভয় ভুলে ইঁদুর গন্ধ শুঁকে বিড়ালের কাছে চলে আসে। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় একে অপরকে শুঁকছে। পরম বন্ধু বৈকি। ঘটনাটা কিন্তু ভিন্ন।
আর খুবই ভয়ঙ্কর। বিড়াল যার জন্য অপেক্ষায় ছিল সে হাজির। এভাবেই ইঁদুরকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। টক্সোপ্লাজমা গন্ডি পরজীবী মূলত বিড়ালের উদরেই বসবাস করে। পরজীবী গুলো বিড়ালকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণও করে।
সাধারণত, বিড়ালের বিষ্ঠার সাথে পরজীবীর ডিম বেরিয়ে আসে। বিড়ালকে তার বিষ্ঠা মাটি চাপা দিতে বাধ্য করায়। যাতে ইঁদুর সহজেই এসব পরজীবীর ডিম পেয়ে যায়। আর এভাবেই জেরির যবনিকাপাত হয়। কি আজব তাই না!
চিত্র-৮: টম-জেরির সাথে পরজীবীর জীবনচক্র
এতক্ষণ প্রাণী-প্রাণী চক্র নিয়ে জানলাম। এখন জানব উদ্ভিদ-প্রাণী চক্র। তোমরা হয়ত অনেকে ‘ব্যাঙের ছাতা’ নামে খ্যাত মাশরুম দেখেছ। আর এই মাশরুমও যদি কাউকে নিয়ন্ত্রণ করে, তবে কেমন লাগে বল? মাশরুমের কি কোনো ফুল বা ফল হয়? উত্তর: অবশ্যই না।
তাহলে তাদের বংশ বৃদ্ধি হয় কীভাবে? এরা তো এক ধরনের উদ্ভিদ, তাই না? আবার কেউ এর চারাও তো লাগিয়ে দেয় না? হঠাৎ করে তাহলে কীভাবে মাশরুম দেখতে পাই? এখানে শেখার বড্ড একটা জিনিস আছে। করডাইসেপ্স জেনাস (Cordyceps Genus) গ্রুপের মাশরুমগুলো তাদের বংশক্রম ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রাণীকে বেছে নেয়।
চিত্র-৯: করডাইসেপ্স জেনাস গ্রুপের মাশরুমের গঠন
প্রথমে এদের স্পোর বাতাসের মাধ্যমে আশেপাশের যথাপোযুক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের বাকল, কাণ্ডে বা পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। এই স্পোরগুলো কিছু পরজীবীর সাহায্যে আস্তে আস্তে উদ্ভিদের বাকল, কাণ্ডে বা পাতায় বলের মতো তৈরি হয়। তা সুগন্ধযুক্ত হয়ে উঠে। আশেপাশের কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করে।
বিশেষ করে এটা পিঁপড়াদের প্রিয় খাবারে পরিণত হয়। পিঁপড়া এসব বল খেলেই স্পোরগুলো সক্রিয় হয়ে যায়। এই স্পোরগুলো একধরনের তীব্র প্রোটিন নিঃসরণ করে যা পিঁপড়াকে মাতাল করে তোলে। নিঃসৃত প্রোটিন পিঁপড়ার মস্তিষ্ককে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
পিঁপড়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়। পিঁপড়ার খাদ্য গ্রহণসহ সব কিছুই স্পোরের মর্জি অনুযায়ী হয়। ফলে পিঁপড়ার অকাল মৃত্যু হয়। পরে পিঁপড়ার পেটে স্পোরের অঙ্কুরোদগম হয়।
চিত্র-১০: পিঁপড়ার শরীর থেকে মাশরুমের জন্ম
মাশরুম জম্ম নেয়। মাশরুম কিন্তু শুধু পিঁপড়াকেই না, আরও অনেক পতঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করে বংশবৃদ্ধি করে থাকে। কি আশ্চর্য ঘটনা, তাই না?
গ্রামের বাড়িতে সন্ধ্যা হলেই চারদিকে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ শুনতে পাই। জান, এই শব্দ কোথা থেকে আসে! ঝিঁঝিঁ পোঁকা এরকম শব্দ করে থাকে। ঝিঁঝিঁ পোঁকা আলোয় আসে বা পানিতে সাঁতার কাটে এবং মারা যায়। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে এরা নিজেরা আত্মহত্যা করছে।
কিন্তু না, এই পোঁকাগুলোর মস্তিষ্ক কিছু পরজীবী দখল করেছে। পরজীবী তদের জীবন চক্রের জন্য তদেরকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়। প্যারাগোর্ডিয়াস ট্রাইকাসপিডেটাস (Paragordius tricuspidus) নামক পরজীবীর লার্ভা মূলত নদীতে বা পুকুরের তীরে থাকে। এদের বসবাস মূলত পানিতে।
চিত্র-১১: প্যারাগোর্ডিয়াস ট্রাইকাসপিডেটাস এর গঠন
ঝিঁঝিঁ পোঁকা সাধারণত নরম মাটিতে বাসা বাঁধে। পুকুর বা নদীর ধারে মাটি মিশ্রিত ডিম ঝিঝি পোঁকা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ডিম ঝিঁঝিঁ পোঁকার উদরে স্পোরে পরিণত হয়। এবং জম্মলাভ করে। এরা দেখতে সুতার মতো। এই পরজীবী ঝিঁঝিঁ পোঁকার পুরো উদর জায়গা করে নেয়।
এক ধরনের প্রোটিন বা রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে। যা ঝিঁঝিঁ পোঁকার স্নায়ুতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। আশেপাশের পানিতে লাফ দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। একসময় ঝিঁঝিঁ পোঁকা পানিতে লাফ দিতে বাধ্য হয়।
চিত্র-১২: ঝিঁঝিঁ পোঁকার শরীর থেকে পানিতে পরজীবীর জন্ম
পরে ঝিঁঝিঁ পোঁকার শরীর থেকে এরা বের হয় এবং পানিতে তাদের বংশবৃদ্ধি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই পরজীবী তাদের বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৯৫% সফল। এভাবে তাদের জীবনচক্র চলতে থাকে।
একবার চিন্তা কর তো, কি রহস্যময় আমাদের সবুজ শ্যমল পৃথিবী। তবে সৃষ্টিকর্তা অপরূপ সাজসজ্জ্বা দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে যাচ্ছেন। ভাব একবার! যারা চিন্তাশীল তাদের জন্য অবশ্যই এগুলো অনেক শিক্ষণীয়।
আজ এখানেই শেষ করছি আমরা। আগামীতে এমন বিচিত্র সব ঘটনার ঝুড়ি নিয়ে আবারও হাজির হব তোমাদের সামনে। কথা দিলাম।
মে-জুন ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ১
No Comment