।মোঃ শফিকুল ইসলাম।
(পর্ব-২)
পর্ব-১ এখানে
গত পর্বের শেষ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। মহাকাশে যান পাঠানো কঠিন নাকি ওখানে অবস্থান করা কঠিন? আসলে মাহাকাশে যাবার পূর্বে ভাবা হত মহাকাশে যাওয়াই কঠিন। একবারে যেতে পারলে আর সমস্যা নেই। কারণ হিসেবে ধরা হত মহাশূন্যের ‘জিরো গ্র্যাভিটি’ বা ওজনহীনতাকে।
মানে মহাশূন্যে কোন বায়ু না থাকায় আর মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ বল কাজ না করায় সেখানে বস্তু ওজনহীন হয়ে যায়। ফলে বাহ্যিক কোন বল প্রয়োগ না করলে গতিশীল বস্তু আজীবন গতিশীল আর স্থিতিশীল বস্তু আজীবন স্থিতিশীলই থেকে যাবে।
অর্থাৎ একটা মহাকাশযানকে যদি কোনো রকমে মহাশূন্যে পাঠানো যায় তাহলে সেটা কোনরকম তেল বা শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই এমনি এমনিই আজীবন ঘুরতে থাকবে- এমনটাই ধারণা করা হত।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল পরিস্থিতি ভিন্ন রকম। মহাশূন্য আসলে শুন্য বা বায়ুহীন না। সেখানে খুবই অল্প পরিমাণে বায়ু রয়েছে। আর এই বায়ুই মহাকাশে নিশ্চিন্তে বসবাসের পথ রোধ করে দিল। এই সামান্য পরিমাণ বায়ুর বাধার কারণে মহাকাশযানের বেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে আর নিচের দিকে নামতে থাকে মানে পৃথিবীর দিকে এগুতে থাকে।
এভাবে একসময় পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের সীমার মধ্যে আসলে পৃথিবীর আকর্ষণে ভূপাতিত হয়ে যাবে। তার মানে মহাকাশে যান পাঠিয়েই শেষ না, সেটাকে চালাতে আরো তেল-খড় পোড়াতে হবে। এছাড়া বায়ুহীন আর ওজনহীন পরিবেশে মানুষ থাকা চাট্টিখানি কথা না। সুতরাং মহাকাশযান প্রেরণ অপেক্ষা অবস্থান করানো অধিকতর কঠিন।
যাইহোক, গত পর্বে স্পুটনিক-১ এবং ভস্টক-১ পর্যন্ত বলেছিলাম। তোমরা কি বলতে পারবে দুটোর মধ্যে পার্থক্য কি? আরো বলেছিলাম সোভিয়েত আর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধের কথা। যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েতের একের পর এক মহাশূন্য অভিযান খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো।
চিত্র-১: এক্সপ্লোরার ১ (বামে) ও স্পুটনিক ১ (ডানে)
সোভিয়েতের স্পুটনিক-১ এর বিপরীতে তারা এক্সপ্লোরার-১ পাঠায় এবং সোভিয়েতের ইউরি গ্যাগারিনের বিপরীতে ১৯৬২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি জন গ্লেন প্রথম আমেরিকান হিসেবে ফ্রেন্ডশীপ-৭ নামক যানে চড়ে মহাশূন্য থেকে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসে।
মহাশূন্য অভিযানের প্রথম কিছু অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে থাকলেও অচিরেই সাফল্যের দেখা পায়। মহাশূন্যে মানুষের প্রথম আগ্রহের বস্তু আর পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশি এবং একমাত্র উপগ্রহ হল চাঁদ। মানুষ সৃষ্টির সূচনা থেকেই চাঁদকে দেখে বিভিন্ন রকমের কাহিনী ফেঁদেছে, গল্প-কবিতা লিখেছে আর অন্তরে চাঁদে যাওয়ার বাসনা পোষণ করেছে। চাঁদের সুতাকাটা বুড়ির সাথে দেখা করার সাধ কিন্তু আমাদেরও কম না।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের অন্তরে বাসা বাধা অধরা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে আসলো দুই পরাশক্তি সোভিয়েত আর যুক্তরাষ্ট্র। চাঁদ বিজয়ের এই লড়াইয়েও প্রথম দিকে এগিয়ে থাকলো সোভিয়েত। ১৯৫৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর সোভিয়েতের লুনা-২ নামক যানটি সফলভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠে প্রথম মানুষ নির্মিত বস্তু হিসেবে অবতরণ করে।
১৯৬৫ সালের ১৮ই মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়নের আলেক্সেই লিওনভ (Aleksei Leonov) প্রথম মানুষ হিসেবে মহাশূন্যে অর্থাৎ মহাকশযানের বাইরে বের হন বা অন্য কথায় মহাশূন্যে হাঁটাহাঁটি করেন, মহাকাশবিদ্যার ভাষায় যাকে স্পেসওয়াক (Spacewalk) বলে। এর আগে ইউরি গ্যাগারিন বা অন্যান্যরা মহাকাশে গমন করলেও মহাকাশযানের বাইরে বের হননি।
চিত্র-২: প্রথম স্পেসওয়াক সম্পন্ন করা মানুষ আলেক্সেই লিওনভ
চাঁদে প্রথম যান লুনা-২ অবতরণের প্রায় দশ বছর পর ২০ জুলাই ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই চাঁদে মানুষের অবতরণ ঘটাতে সক্ষম হয়। তোমরা সবাই জানো আমেরিকান মহাকাশচারী নেইল আর্মস্ট্রং হলেন চাঁদে পা দেয়া প্রথম সৌভাগ্যবান ব্যক্তি এবং বাজ অ্যাল্ড্রিন ছিল দ্বিতীয় ব্যক্তি। আর মহাকাশযানটি ছিল অ্যাপোলো-১১।
অ্যাপোলো-১১ মহাকাশযানটি ‘স্যাটার্ন ভি’ নামক একটি রকেটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। অ্যাপোলো-১১ যানটির তিনটি অংশ ছিল।
১। কমান্ড মডিউল: যেখানে তিনজন আরোহীর জন্য কেবিন ছিল এবং একমাত্র অংশ যেটা পৃথিবীতে আবার ফিরে এসেছিল। এর নাম ছিল ‘কলাম্বিয়া’।
২। সার্ভিস মডিউল: এর কাজ ছিল কমান্ড মডিউল ও আরোহীদের বিদ্যুৎ, শক্তি, অক্সিজেন এবং খাবার দিয়ে সাপোর্ট দেয়া।
৩। লুনার মডিউল: এর কাজ ছিল আরোহীদের যান থেকে চাঁদে অবতরণ করানো এবং কমান্ড মডিউলে ফেরত আনা। এর নাম ছিল ‘ঈগল’।
চিত্র-৩: লঞ্চপ্যাডে অ্যাপোলো-১১ ও স্যাটার্ন ভি
কথা হল এত আলাদা অংশ করার মাহাত্ম্য কী? আসলে আমরা ভাবছি যে মহাকাশযান হল ছোটাখাট একটা সরু যান বিশেষ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলো আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক বড়। বিশেষ করে রকেটের কারণে। আর প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি লাগে বলে রকেটের আকৃতিও বিশালাকার হয়।
রকেট মূল মহাকাশযানের অংশ না বরং এটা বহনকারী মাত্র। আর এর জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে সেটি খোলস ছাড়া আর কিছু নয়। এজন্য একটা সময় পর তা আলাদা করে ছেড়ে দেয়া হয়। কারণ এত ওজনের খোলস বহন করার কোন অর্থ হয়না।
ঠিক অন্যান্য অংশও প্রয়োজন শেষে আলাদা করে দেয়া হয় এবং সবার শেষে একেবারে অপরিহার্য অংশটুকু পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয় কারণ পাঠানো যেমন খরচসাপেক্ষ, ফিরিয়ে আনাও তাই।
অ্যাপোলো-১১ পৃথিবীর অরবিটে (কক্ষপথ) পৌঁছার পরই রকেটটি ছেড়ে দেয়। এরপর আরো তিনদিন লাগে চাঁদের কক্ষপথে যেতে। সেখান থেকে আর্মস্ট্রং আর এলড্রিন ‘ঈগল’ নামক লুনার মডিউলে (ছোট যান বিশেষ) করে চাঁদে অবতরণ করেন।
মাইকেল কলিনস ছিলেন এই অভিযানের তৃতীয় ব্যক্তি যিনি চাঁদে সরাসরি অবতরণ করেননি বরং কমান্ড মডিউলে অবস্থান করেছিলেন। আর্মস্ট্রং আর অ্যাল্ড্রিন চাঁদের পৃষ্ঠে হাঁটাহাঁটি করেন, ছবি তুলেন, ওখানকার মাটি সংগ্রহ করেন, চাঁদে আমেরিকার পতাকা স্থাপন করেন ও তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডির সাথে ফোনে কথা বলেন।
চিত্র-৪: অ্যাল্ড্রিন ও লুনার মডিউল ‘ঈগল’
তারা মোট ২১.৫ ঘন্টা চাঁদে অবস্থান করেন। মোট আট দিনের এই অভিযান শেষে ২৪ জুলাই তাদের প্রশান্ত মহাসাগরের কোন এক জায়াগায় প্যারাশুটের মাধ্যমে অবতরণ করানো হয়। প্যারাশুটের মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠে এভাবে মহাকাশযান অবতরণ করানোকে স্প্ল্যাশডাউন (Splashdown) বলে।
চাঁদে মানুষের অবতরণের ঘটনার সাথে যে মানুষের নাম না নিলে অন্যায় করা হবে তিনি হলেন তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। মানুষ বলে রাজনীতিবিদরা শুধু ক্ষমতার পিছনে ছোটে কিন্তু সত্যিকার রাজনীতিবদরা সভ্যতার পিছনে ছোটে।
এই অভিযান মূলত সফল হয় ১৯৬১ সালে কেনেডির দেয়া এক ঘোষণার কারণে। ঘোষণাটি ছিল- “আগামী দশক শেষ হবার আগেই মানুষ সফলভাবে চাঁদের বুকে অবতরণ করবে এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসবে” । এবং এই ঘোষণার আট বছরের মাথায় মানুষ চাঁদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়।
যদিও চাঁদে মানুষের প্রথম অবতরণ নিয়ে কিছু বিতর্ক তৈরি হয়েছিল যেমন, চাঁদে হাঁটাহাঁটি (চাঁদে অভিকর্ষ বল পৃথিবীর মাত্র প্রায় ১৬%, g = 1.625 m/s2), পতাকা স্থাপন করা ইত্যাদি। অনেকে এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের সোভিয়েতকে পেছনে ফেলার জন্য একটা বানোয়াট কাহিনী বলেও উল্লেখ করে থাকে।
চিত্র-৫: ‘কলাম্বিয়া’, অ্যাপোলো-১১ এর একমাত্র অংশ যা পৃথিবীতে ফিরে আসে
কিন্তু আমরা ইতিবাচক চিন্তা করি এবং মনে করি নিঃসন্দেহে এই পদক্ষেপ মহাবিশ্বের সর্বত্র মানুষের বিচরণের নতুন দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। মহাশূন্যে এমনকি চাঁদে মানুষের অবতরণ তো হল এরপর কি? হুম এরপর হল বসবাস। শুধু জয় করে ছেড়ে দিলে তো হবে না, ওখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
মহাশূন্যে মানুষের বসবাসের জন্য গবেষণার নিমিত্তেই তৈরি হয়েছে আজকের ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস ষ্টেশন’ যা আমাদের মাথা থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার ওপর দিয়ে দশজন ক্রু নিয়ে দিনে প্রায় ষোলবার করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে যাচ্ছে।
তবে আজকের এই ইন্টারন্যাশনাল স্পেস ষ্টেশন একদিনে এই অবস্থায় আসেনি বরং পাড়ি দিতে হয়েছে লম্বা পথ। আমাদের বাকি গল্প সেই পথেরই।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৩
No Comment