শিক্ষার্থী, সিএসই বিভাগ
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস- (বিইউপি)
বর্তমান যুগে আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী মোবাইল ফোন। বিনোদনের ক্ষেত্র হিসেবে কিংবা শিক্ষামূলক কাজ- যেকোন ক্ষেত্রেই এর ভূমিকা দিন থেকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময় ফোন কল করা কিংবা খুদেবার্তা পাঠানোর ভেতরেই মোবাইল ফোনের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল।
তবে কালের পরিক্রমায় এর ব্যবহারের ক্ষেত্র দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে বিস্তৃত হয়েছে। স্মার্টফোনের মূল কেন্দ্রবিন্দু বা মস্তিষ্ক হচ্ছে এর প্রসেসর। চলো, সে সম্পর্কে আজ কিছু ধারণা নেয়া যাক!
প্রথমত, প্রসেসর বা চিপসেট সম্বন্ধে জানার পূর্বে এর আক্ষরিক অর্থ জানতে হবে। সোজাসাপ্টা ভাষায় যেখান থেকে মোবাইল ফোনের বিভিন্ন কাজ কেন্দ্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেটা প্রসেসর হিসেবে পরিচিত। প্রথম স্মার্টফোন আইবিএম সাইমন ওরফে আইবিএম সাইমন পার্সোনাল কমিউনিকেটর দিয়ে প্রসেসরের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এটি একটি হ্যান্ডহেল্ড পিডিএ (Personal Digital Assistant)।
এটি প্রথম টাচস্ক্রিন ডিভাইস যা ফোন কল করা এবং গ্রহণ করার পাশাপাশি ফ্যাক্স, ইমেল এবং পেজার পাঠ্য বা সেলুলার পৃষ্ঠাগুলি প্রেরণ এবং গ্রহণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। “নোকিয়া 9000 কমিউনিকেটর” নামে নোকিয়া তার নিজস্ব পিডিএ কোডনেম নিয়ে এসেছিল। এটি ছিল নকিয়া কমিউনিকেটর সিরিজের প্রথম পণ্য।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে থাকি। সে সকল অ্যাপ কতটা দ্রুত কাজ করবে সেটার কিয়দংশ প্রসেসরের উপর নির্ভরশীল। কাজের উপর নির্ভর করে প্রসেসরের বিভিন্ন ধরনের কোর বিদ্যমান; ডুয়েল/কোয়াড/হেক্সা/অক্টা কোর প্রভৃতি।
কোর মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় আগত বিভিন্ন প্রকার কাজকে বিভক্ত করে দেয়। আপনি যদি আপনার স্মার্টফোনে অনেকগুলো অ্যাপ ব্যবহার করেন তবে কাজের মাত্রা অনুযায়ী একটি সারি তৈরি হবে। সারিটি দীর্ঘ হলে এর কিছু অংশ পরবর্তী কোরে যাবে।
বর্তমান সময়ের সবচে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত প্রসেসর সমূহ হচ্ছে কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন, মিডিয়াটেক, হাইসিলিকন, অ্যাপল বায়োনিক, ইউনিসক, এক্সিনোস প্রমুখ।
এবার সেসব প্রসেসর সম্পর্কে অল্প ধারণা নেয়া যাক-
১. Qualcomm Snapdragon:
কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন একটি আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টর ও টেলিকমিউনিকেশন ইক্যুইপমেন্ট কোম্পানি। এটি সিস্টেম অন চিপ (SOC) হিসেবে সমাদৃত, যা একটি প্রসেসর, গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট বা জিপিইউ, মেমরি কন্ট্রোলার, মডেম সেলুলার নেটওয়ার্ক কিংবা ব্লুটুথ এর জন্য, আইএসপি বা ডিএসপি (অডিও কিংবা ছবির ক্ষেত্রে বার্তা প্রেরক) দ্বারা গঠিত।
‘CDMA’ নির্ভর স্মার্টফোন বাজারে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তারা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বর্তমান সময়ে স্ন্যাপড্রাগনের জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে অ্যান্ড্রয়েড মার্কেটে প্রসেসরের আদর্শ সূচক হিসেবে তাদের বিবেচনা করা হয়।
স্ন্যাপড্রাগন বিভিন্ন রেঞ্জের স্মার্টফোনের জন্য বেশ কিছু সিরিজ রেখেছে। যেমন তাদের 800 সিরিজ ফ্ল্যাগশিপ ফোনের জন্য, 600/700 সিরিজ মিডরেঞ্জ কিংবা হায়ার মিড রেঞ্জ ফোনের জন্য এবং সর্বশেষ 400 সিরিজ এন্ট্রি লেভেল বাজেট স্মার্টফোন এর জন্য বরাদ্দকৃত।
এদের প্রসেসর সম্বলিত বেশ কিছু জনপ্রিয় স্মার্টফোন হচ্ছে, OnePlus 9/Google Pixel 5a/Samsung Galaxy S20 series/Asus Zenfone 6/ Redmi Note 3 প্রভৃতি।
২. Mediatek:
মিডিয়াটেক একটি তাইওয়ান ভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি। এরা সর্বপ্রথম কোম্পানি যারা অক্টা-কোর সম্বলিত প্রসেসর ডেভেলপ করে। নতুন নতুন উদ্ভাবনের জন্যও এই টেক কোম্পানি বেশ পরিচিত। এছাড়াও সবচে সহজলভ্য প্রসেসর প্রক্রিয়াজাতকরণের দিক থেকেও এরা এগিয়ে।
মিডিয়াটেকেরও বেশ কিছু সিরিজ বিদ্যমান তন্মধ্যে Helio G/P, Dimensity প্রভৃতি বহুল ব্যবহৃত। এদের প্রসেসর সম্বলিত বেশ কিছু জনপ্রিয় হ্যান্ডসেট মডেল হচ্ছে Redmi Note 4, Realme 8, Oneplus Nord 2 প্রভৃতি। বর্তমানে মিডিয়াটেক স্ন্যাপড্রাগনের সঙ্গে হেড টু হেড প্রতিযোগিতা করছে।
৩. Apple Bionic:
মোবাইল ফোন প্রসেসরের ক্ষেত্রে সবচে আধিপত্য বিস্তারকারী এবং টপ লিস্টেড পজিশনে অ্যাপল বায়োনিকের নাম উঠে আসবে। অ্যাপল অন্যান্য সব কোম্পানির ন্যায় Arm’s 64-bit architecture দ্বারা প্রসেসর তৈরি করে।
তবে তারা Arm এর বিশেষ architectural লাইসেন্সধারী যার ফলশ্রুতিতে নিজেদের ইচ্ছেমতো একদম শেকড় থেকে চিপসেট সমূহ ডিজাইন করতে পারে। এক্ষেত্রে অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় তারা অনন্য। তাদের প্রথম উদ্ভাবিত Arm প্রসেসর ছিল Apple A7, যা আইফোন 5s-এ ব্যবহৃত হয়।
৪. Exynos:
জনপ্রিয় টেক নির্মাতা কোম্পানি স্যামসাং হচ্ছে এই প্রসেসরের স্বত্বাধিকারী। সাধারণত স্যামসাংয়ের গ্লোবাল ভ্যারিয়েন্ট ফোন সমূহ exynos প্রসেসর সম্বলিত হয়। Arm7 CPU এর উপর নির্ভর করে ২০০০ সালে সর্বপ্রথম স্যামসাং তাদের SOC S3C44B0 বাজারজাত করে। এছাড়াও exynos 3 single ছিল ইন্ডাস্ট্রির সর্বপ্রথম 1 gigahertz সম্বলিত প্রসেসর।
Exynos octa 8890 ছিল তাদের সর্বপ্রথম প্রিমিয়াম সিরিজের প্রসেসর। Exynos 7420- ২০১৪ সালের শ্রেষ্ঠ প্রসেসর হিসেবে [অ্যান্ড্রয়েডের মধ্যে] মনোনীত হয়। জনপ্রিয় বেশ কিছু এক্সিনোস প্রসেসর সম্বলিত ফোনগুলো হচ্ছে, Samsung Galaxy S22 Ultra, Samsung Galaxy S22+, Samsung Galaxy S21 Ultra প্রমুখ।
৫. HiSilicon:
আরো একটি জনপ্রিয় টেক নির্মাতা কোম্পানি হুয়াওয়ে এর স্বত্বাধিকারী। যদিও বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে গ্লোবাল মার্কেটে তাদের এখন আর এতটা নামডাক শোনা যায় না। তবে একসময় তাদের চিপসেট সম্বলিত ফোনগুলো অন্যান্য ফোন নির্মাতা কোম্পানিগুলোর হেড টু হেড প্রতিযোগিতা করতো।
অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের ন্যায় তারাও নিজেদের প্রসেসর নিজেরা ডিজাইন করে। HiSilicon এর জন্ম ২০০৪ সালে। সে সময়ে তারা বিভিন্ন প্রকার সার্কিট, মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইন করতো। Richard Yu তাদের কোম্পানি হেড হওয়ার পর থেকে মোবাইল ফোনের জন্য SoC (system-on-chip) তৈরির যাত্রা শুরু হয়।
প্রথম উল্লেখযোগ্য সিরিজ ছিল K3, ২০১২ সালের দিকে। হুয়াওয়ে তাদের প্রসেসর অন্য কোন থার্ড পার্টির কাছে বিক্রি না বরং নিজস্ব মোবাইল ফোনের জন্যই মজুদ রাখে।
পরিশেষে, প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ব্যাপ্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলো। এক সময় দেখা যাবে কম্পিউটারের যাবতীয় কাজ মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই সম্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে।
No Comment