।ডা. মো. ফজলুল কবির পাভেল।
১. ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানি
১.১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী কি রক্ত দিতে পারবেন?
অনেকের মাঝেই এ বিষয়ে প্রশ্ন আছে। প্রায়ই এ ধরনের সমস্যার অনেকে পড়েন। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে সবারই ধারণা থাকা প্রয়োজন। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীরা রক্ত দিতে পারবেন। তবে কারো যদি রক্তে গ্লুকোজ বেশি থাকে তবে তিনি রক্ত দিতে পারবেন না।
অনেকেরই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি রক্ত দিতে চান তবে আগে অবশ্যই গ্লুকোজ মেপে নিতে হবে। শুধু যে গ্লুকোজ দেখেই ডায়াবেটিস রোগীর কাছ থেকে রক্ত নেওয়া যাবে তা নয়। সেই ডায়াবেটিক রোগী অন্যান্য দিকেও সুস্থ থাকতে হবে।
তার চোখ কিডনি বা হার্টে সমস্যা থাকলে রক্ত নেওয়া যাবে না। রক্ত দেওয়ার আগে ডায়াবেটিক রোগীর পর্যাপ্ত পানি এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় রক্ত জীবন বাঁচানোর জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। সুস্থ সবল মানুষের নিয়মিত রক্ত দেয়া উচিত।
রক্ত দিলে শরীরের কোনই ক্ষতি হয় না। বাংলাদেশে রক্তের চাহিদা অনেক। কিন্তু সরবরাহ অপ্রতুল। তাই অনেক সময় অসুস্থ রোগী থেকেও রক্ত নিতে হয়। সুস্থ ব্যক্তি পাওয়া গেলে অসুস্থ ব্যক্তির থেকের রক্ত না নেওয়াই ভালো।
১.২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা কি খুব কঠিন?
এক সময়ে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বেশ কঠিন ছিল। ইনসুলিন আবিষ্কারের পূর্বে রোগীরা মাত্র ৫-৭ বছর বাঁচতো। ১৯২১ সালে ইনসুলিন আবিষ্কারের পর ডায়াবেটিসের চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে এসেছে। অনেক জটিলতা কমে এসেছে। মুখে খাবার ওষুধ নিয়মিত আবিষ্কার হচ্ছে। এখন তাই ডায়াবেটিসের চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে এসেছে।
ডায়াবেটিস চিরদিনের রোগ। একবার হয়ে গেলে আর ভাল হয় না। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় সব জায়গায় ডায়াবেটিসের প্রায় সব রকমের ওষুধই পাওয়া যায়। এসব ওষুধের দামও নাগালের মধ্যে। বেশিরভাগ ওষুধ একবেলা খেলেই চলে। ইনসুলিন পেন বর্তমানে রোগীর জন্য আশীর্বাদস্বরুপ।
এতে তেমন কোনো ব্যাথা হয় না এবং ব্যবহার খুব সহজ। দরকার শুধু সচেতনতা এবং সময়মতো ওষুধ গ্রহণ করা। ডায়াবেটিসের চিকিৎসা এখন আরও কঠিন কোন বিষয় নয়। ওষুধের পাশাপাশি দক্ষ চিকিৎসকও তৈরি হয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে অনেক ডায়াবেটিস সেন্টার খোলা হয়েছে। নিয়মিত চলছে সেমিনার ও গবেষণা। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে চিকিৎসা আরও সহজ হবে।
২. হোমোসিস্টিনিউরিয়া
এটি একটি বংশগত রোগ। এক ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড মিথিওনিনের বিপাকের গোলমালের কারণে এই রোগ দেখা যায়। হোমোসিস্টিনিউরিয়া এবং অটোজোমাল রিসোসিভ টাইপের অসুখ। অর্থাৎ ত্রুটিযুক্ত জিন বাবা এবং মা উভয় থেকেই সন্তান লাভ করে।
জিনের ত্রুটির কারণে সিস্টাথিয়োন বিটা থিন্থেটেজ এনজাইম ঠিকমত তৈরি হয় না। ফলে রোগটি দেখা দেয়। হোমোসিস্টিনিউরিয়াতে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে-
১। বাচ্চা ঠিকমত বেড়ে ওঠে না।
২। চোখে দেখতে সমস্যা হয়।
৩। বুকের গঠনের সমস্যা থাকে।
৪। হাঁটু ঠিকমত বাঁকাতে পারে না।
৫। হাত-পা লম্বা হয়।
৬। রোগী লম্বা হয়।
৭। মানসিক গঠন ঠিকমত হয় না।
৮। মানসিক সমস্যা থাকে।
৯। দূরের জিনিস ঠিকমত দেখতে সমস্যা হয়।
১০। আঙ্গুলের গঠনে সমস্যা থাকে।
অভিজ্ঞ চিকিৎসক বিভিন্ন উপসর্গ দেখেই এ রোগ সম্পর্কে ধারনা পান। তবে আমাদের দেশে রোগটি তত পরিচিত নয়। ‘মারফ্যান সিনড্রোমের’ সাথে এর মিল আছে। ভালভাবে পরীক্ষা করলে সেটি ধরা যায়। নিশ্চিত হওয়ার জন্য অ্যামাইনো অ্যাসিড, জেনেটিক টেস্ট এবং এনজাইম মাপা হয়। চোখের লেন্সের সমস্যা হয় বলে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হয়।
হোমোসিস্টিনিউরিয়ার সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। কারো কারো ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার ভিটামিন বি দিয়ে ভাল ফল পাওয়া গেছে। মিথিওনিন যেসব খাবারে বেশি আছে তা কম খেতে বলা হয়। তবে ওষুধ বা মিথিওনিনযুক্ত খাবার কম খেলেও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হয় না।
ফলিক অ্যাসিড এবং এক ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড সিস্টিন দিয়েও এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। হোমোসিস্টিন রক্তে বেড়ে গেলে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ফলে হৃদরোগ ও স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
লেন্স সার্জারি করে ঠিক না করলে দেখতে সমস্যা হয়। উন্নত বিশ্বে গর্ভাবস্থায় এ রোগ আছে কিনা নির্ণয় করা যায়। আমাদের দেশে এই রোগ তেমন দেখা না গেলেও ভবিষ্যতে এদেশেও বাড়তে পারে।
৩. অ্যাক্রোমেগালি
এটি এক ধরণের হরমোনের সমস্যা । আমাদের মাথায় পিটুইটারি নামক গ্রন্থি থাকে। বিভিন্ন হরমোন এখান থেকে বের হয়। অ্যাক্রোমেগালি অসুখে এই গ্রন্থি থেকে প্রচুর পরিমাণ গ্রোথ হরমোন উৎপন্ন হয়। আর অতিরিক্ত গ্রোথ হরমোন উৎপন্ন হওয়ার কারণে বিভিন্ন সমস্যা হয়। এই রোগে হাত এবং পা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এবং সেই সাথে মুখের আকারও বেড়ে যায়।
অ্যাক্রোমেগালিতে বিভিন্ন লক্ষণ থাকে। এর মধ্যে আছে :
১) হাত-পা বড়ো হয়ে যাওয়া
২) মুখ বড়ো হয়ে যাওয়া
৩) মাংসপেশিতে দুর্বলতা
৪) ক্লান্তি
৫) জিহবা বড়ো হয়ে যায়
৬) মাথাব্যাথা
৭) চোখে দেখতে সমস্যা হয়
৮) অস্থিসন্ধিতে ব্যাথা
৯) মেয়েদের ক্ষেত্রে মাসিক অনিয়মিত হয়
অ্যাক্রোমেগালি থেকে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এখান থেকে হতে পারে উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপ থেকে আবার নানা সমস্যা হতে পারে। এই রোগ থেকে হার্টের সমস্যা হতে পারে। অস্টিওআথ্রাইটিস এবং ডায়াবেটিসও হতে পারে।
অ্যাক্রোমেগালি থাকলে কোলন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। স্লিপ অ্যাপনিয়া, কার্পাল টানেল সিন্ড্রোম এবং চোখে দেখতেও সমস্যা হয়। এই অসুখ যেহেতু অতিরিক্ত গ্রোথ হরমোনের কারণে হয়ে থাকে তাই গ্রোথ হরমোনের পরিমাণ কমাতে হবে।
এর জন্য বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করা হয়। সার্জারি রেডিওথেরাপিও লাগে। কার জন্য কোন চিকিৎসা লাগবে তা একজন বিশেষজ্ঞই ঠিক করবেন। ওপরের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে। নাহলে ভবিষ্যতে নানা জটিলতা হতে পারে।
৪. অ্যাকিউট সাইনুসাইটিস
খুব পরিচিত এক অসুখ অ্যাকিউট সাইনুসাইটিস। অনেকেই এই সমস্যায় কষ্ট পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন। সাইনুসাইটিস একটি অতি সাধারণ রোগ। শতকরা প্রায় পঁচিশ ভাগ মানুষ এই রোগে কষ্ট পান। আমাদের নাকের চারপাশে অস্থিতে বাতাসপূর্ণ কুঠুরি থাকে যাদেরকে সাইনাস বলা হয়।
সাইনুসাইটিস হলো উক্ত সাইনাসসমূহের ইনফেকশন বা প্রদাহ। সাইনাসসমূহের প্রদাহের মধ্যে ম্যক্সিলারি সাইনাসের প্রদাহ সবচেয়ে বেশি হয়। নাকের ইনফেকশন থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাইনাসে ইনফেকশন ছড়িয়ে যায়। এ ছাড়া দাঁতের ইনফেকশন থেকেও সাইনাসে সংক্রমণ হতে পারে।
অ্যাকিউট সাইনুসাইটিসে বিভিন্ন উপসর্গ থাকে। এর মধ্যে আছে :
১। নাকের পাশে, মাথার সামনের দিকে এবং মাথার দুই পাশে ব্যাথা
২। মাথা ভারী হওয়া
৩। নাক দিয়ে পানি পড়া
৪। নাক বন্ধ থাকা
৫। অস্বস্তি
৬। কাজকর্মে অনীহা
৭। শরীর ম্যাজম্যাজ করা
৮। বমিভাব
৯। জ্বর ইত্যাদি
সাইনাসের ইনফেকশনের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। যেহেতু সাইনুসাইটিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া দিয়ে হয় তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে। ব্যাথার জন্য ব্যাথানাশক ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
নাকের ড্রপ এবং অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ লাগতে পারে। নাকে মেনথল দিয়ে গরম পানির বাষ্প নিলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। এটি খুব পরিচিত সমস্যা। তবে ভয়ের কিছু নেই। চিকিৎসা নিলে অনেক আরামে থাকা যায়।
মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১
https://www.byapon.com/2023/mixed/ogni-nirbaponer-kotokotha.html
No Comment