।জায়েদ শাহনেওয়াজ।
আমরা এখন বাস করছি আধুনিক যুগে। বিজ্ঞান আমাদের জন্য আরও অনেক চমক বাকি রেখেছে সামনে। জানি না পৃথিবীর আর কতটুকু সময় বাকি রয়েছে। কিন্তু যতদিন এই মানবসভ্যতা টিকে থাকবে ততদিন আবিষ্কার রথ চলতেই থাকবে। তাই সময় এখন এগিয়ে যাওয়ার।
কিন্তু আমি এখন কিছু বকবক করবো আদি যুগের একটি সভ্যতা এবং তাদের কিছু অসাধারণ আবিষ্কার নিয়ে। আর এটি হলো মেসোপোটেমীয় সভ্যতা। যাদের ইতিহাস নিয়ে সামান্য জ্ঞান আছে তারা হয়তো এই সভ্যতার নাম শুনে থাকবে। তাহলে চলো ঢুকে পড়ি এই সভ্যতায়। দেখে আসি কেমন ছিলো তাদের জীবন আর কী দিয়েছে তারা বিজ্ঞান জগতকে।
চিত্র-১ : মেসোপোটেমীয়ান সভ্যতার এলাকা
মেসোপোটেমীয়া শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল’। আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা সভ্যতা– যা আজকের দিনের ইরাক, কুয়েত, সিরিয়া এবং তুরস্কের কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত ছিলো।
ব্রোঞ্জ যুগেরও প্রায় এক হাজার বছর আগে সুমেরিয়ান এবং আক্কাদিয়ান জনগোষ্ঠী এই সভ্যতা বিনির্মাণ করে। প্রাচীন কালে পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিলো এই মেসোপোটেমীয় সভ্যতা। ব্যাবিলন, উর, উরুক নামক সমৃদ্ধ শহর ছিলো এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত।
ধারণা করা হয় চাকা দিয়ে তৈরি গাড়ির প্রচলন শুরু হয় এই সময়ে সুমেরিয়ানদের দ্বারা। প্রত্নতত্ত্ববিদ লিয়োনাদ ওলি উর শহরে খনন কাজ করে একটি পাথরে খোদাই চিত্রফলক পান যেখানে দুই চাকাওয়ালা একটি গাড়ি দেখা যায়। ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো গাড়ির ছবি এই সভ্যতায় সর্বপ্রথম পাওয়া যায়।
ক্ষেতে কাজ করার জন্য লাঙল, সেচকাজ, খাদ্যের মজুদকরণ এসব জিনিস উদ্ভাবন করেছে এই সভ্যতার লোকেরা। সর্বপ্রথম পোড়া ইট দিয়ে বাড়ি নির্মাণ তাদের আবিষ্কার। তাদের তৈরি সবচেয়ে পুরানো মন্দির জিগ্রুলাসে দেখা যায় পোড়ামাটির তৈরি বিভিন্ন চিত্রশিল্প।
তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ সমকর্মবন্টন নীতি ছিলো। যেহেতু এদের প্রধান পেশা ছিলো কৃষিকাজ, তাই নারী-পুরুষ সবাইকেই কৃষিকাজ করতে হতো। এদের ঈশ্বরের উপরে বিশ্বাস ছিলো। তাদের প্রধান ঈশ্বর ছিলো অনু। এছাড়া তারা বায়ুমণ্ডলের দেবতা এনলিন এবং জ্ঞানের দেবতা হিসেবে এনকির ওপর বিশ্বাস রাখতো। এছাড়াও তাদের আরো হাজার খানেক দেবতা ছিলো বলে ধারণা করা হয়।
চিত্র ২ : মেসোপোটেমীয়দের ঘোড়ার গাড়ি
সাহিত্যকলা নিয়েও তাদের ছিলো ব্যপক বিচরণক্ষেত্র। তারা কথা বলতো সোমাটিক ভাষায়। এ ছাড়া নরম মাটির ওপর বিভিন্ন চিত্র কর্ম তৈরি করতো যাকে আধুনিক ভাষায় ক্রিপ্টোগ্রাফি বলে। তারা লিপি আবিষ্কার করেছিল।
আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বের কিছু মেসোপোটেমীয় ফলক পাওয়া যায়– যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাকাব্য লিখা হয়েছে এই সভ্যতায়। এটির নাম গিলগামেশ। এটি এখন বৃটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সালের দিকে এই যুগের সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাঁদনেজার তার প্রিয় স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করেন হ্যাঙ্গিং গার্ডেন বা শূন্য উদ্যান নামক প্রাসাদ। এটি এখন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি। বলা হয়ে থাকে এই প্রাসাদে প্রায় ছয় হাজার পদের ফুলগাছ ছিলো। ঐতিহাসিকদের মতে একটি বড় ভূমিকম্পে এটি ধ্বংস হয়ে যায়।
মেসোপোটেমীয়রা গণিতে ব্যপক সাফল্য অর্জন করেছিল। তাদের সংখ্যা ছিলো ষাট পর্যন্ত– যার ফলে তারা মিনিট এবং ঘণ্টাকে ষাট ভাগে ভাগ করে ফেলে। তারা একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল যেখানে বারো মাসের হিসেব ছিলো প্রতি মাস ত্রিশ দিন করে। পানির সাহায্যে পৃথিবীর প্রথম ঘড়ি এদের হাতেই তৈরিকৃত।
চব্বিশ ঘণ্টায় যে একদিন হয় এটা তারাই প্রথমে বলেছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনিয়রা যা আবিষ্কার করেছে তা এখনো আমরা ব্যবহার করছি কিঞ্চিৎ মার্জিত রূপে!
চিত্র ৩ : ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান
এই সভ্যতাই সর্বপ্রথম ব্রোঞ্জ তৈরি করে। তামা আর টিনকে একসাথে গলিয়ে এই সংকর ধাতু এই সভ্যতায় তৈরি হয় বিধায় এই যুগকে ব্রোঞ্জযুগ বলা হয়। ব্রোঞ্জের আবিষ্কারের ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে এবং কৃষিকাজে এদের দক্ষতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ ছাড়াও তারা কাচের ব্যবহার জানতো।
মেসোপোটেমীয়রা বিজ্ঞানের কিছু অসাধারণ আবিষ্কার করে গিয়েছে। পৃথিবী যে গোলাকার সেটা এই সভ্যতার লোকেরা সর্বপ্রথম ধারণা করেছিল। এজন্য তারা পৃথিবীকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করার পরিকল্পনা করেছিলো।
সভ্যতার আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চল মিশরীয় সভ্যতা থেকে অনেকটাই ভিন্ন ছিল এবং বহিঃশত্রুদের থেকে খুব একটা সুরক্ষিত ছিল না বলে বারবার এর ওপর আক্রমণ চলতে থাকে। পরবর্তী সময়ে এখান থেকেই ব্রোঞ্জ যুগে আক্কাদীয়, ব্যাবিলনীয়, আসিরীয় ও লৌহ যুগে নব্য-আসিরীয় এবং নব্য-ব্যাবিলনীয় সভ্যতা গড়ে উঠে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ সালের দিকে মেসোপোটেমীয়া পার্সিয়ানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু পরে এই ভূখণ্ডের আধিপত্য নিয়ে রোমানদের সাথে তাদের যুদ্ধ হয় এবং রোমানরা এই অঞ্চল দখল করে নেয়। কিন্তু তারা ২৫০ বছরের বেশি শাসন করতে পারেনি।
দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে পার্সিয়ানরা আবার এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চল তাদের শাসনেই থাকে। এরপর মুসলিম শাসনামল শুরু হয়। মুসলিম খিলাফত শাসনে এই অঞ্চল পরবর্তীতে ইরাক নামে পরিচিতি লাভ করে।
এতো সমৃদ্ধ একটি সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ এখনও পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় ভূমিকম্প, বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও দূর্যোগ সবমিলিয়ে এই সভ্যতা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
চিত্র ৪ : সুমেরিয় মেসোপোটেমীয়ানদের সংখ্যা
এসব নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের বলা হয় আর্কিওলজিস্ট। প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে খনন কাজের মাধ্যমে এভাবেই সেসময়ের সবকিছু খুঁজে বের করা হয়। শুধু একবার চিন্তা করে দেখো, যে সিংহাসন বা অঞ্চল খনন করে পাওয়া যাচ্ছে সেখানে বসেই হয়তো কোন এক পরাক্রমশালী সম্রাট বিশাল এক সাম্রাজ্য শাসন করতো!
আর আজ সেগুলো মাটির নীচে। পৃথিবী একসময় সবকিছুই তার বুকের মধ্যে টেনে নেয়। আর বোকা মানুষ মনে করে সে পৃথিবীতে সারাজীবন রাজত্ব করবে! কী অদ্ভুত, তাই না!
জুলাই-আগস্ট ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ২
No Comment