।মোঃ শফিকুল ইসলাম।
চাঁদ নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনা কেবল সাহিত্যের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই চাঁদ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে আর অন্তরে চাঁদে যাবার স্বপ্ন পোষণ করেছে। এভাবে যে কত মানুষ স্বপ্ন বুকে নিয়েই পরপারে চলে গেল তার খোঁজ আর কে রাখে।
তবে আমরা সৌভাগ্যবান বলা চলে। বলতে গেলে আমাদের চোখের সামনেই চাঁদের বুকে পা রাখার দৃশ্য অবলোকন করতে পেরেছি। আর বলা যায় না, কপালে থাকলে আমাদের মধ্য থেকেই কেউ হয়তো চাঁদে পা রাখবে ইনশাআল্লাহ।
‘মহাশ্যূন্যে বসবাস’ সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে চন্দ্র অভিযান সংক্ষেপে বর্ণনা করেছিলাম। আজকে আরেকটু বিস্তারিত বলার চেষ্টা করবো। সেই সাথে চাঁদ নিয়ে ইতিহাস ও বর্তমানের গবেষণা সম্পর্কেও বলার চেষ্টা করবো।
আল্লাহর নবী ঈসা (আ.) এর জন্মের প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে মধ্য আমেরিকায় মায়া সভ্যতা বিচরণ করতো। মায়া জাতির মানুষরা মনে করতো- আকাশে যেসব জিনিস যেমন চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, তারা ইত্যাদি আমরা দেখি এগুলো সবই আগে পৃথিবীর অংশ ছিল।
চাঁদ ছিল এক সুন্দরী যুবতী আর সূর্য ছিল এক সাহসী শিকারী যুবক। তারা একে অপরের প্রেমে পরে এবং একসাথে অনেক দূরে পালিয়ে যায়। এদিকে তরুণী চাঁদের দাদামশায় তার জন্য পাগল হয়ে যায় এবং চাঁদকে খুঁজে বের করে হত্যা করে।
এরপর ড্রাগনফ্লাইরা (ফড়িংসদৃশ বড় পোকাবিশেষ) চাঁদের শরীর এবং রক্ত সংগ্রহ করে তেরোটি পাতাবিহীন গাছের ফাঁকা কান্ডের মধ্যে রেখে দেয়। এদিকে সূর্য বারো দিন ধরে চাঁদকে হন্যে হয়ে খুজতে থাকে। তেরোতম দিনে সে গাছের কান্ডগুলো খুঁজে পায়।
কান্ডগুলোর মধ্য থেকে বারোটি কান্ড ক্ষতিকর পোকামাকড় আর সাপকে জীবন দান করে যারা সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পরে। আর তেরোতম কান্ড থেকে চাঁদ নতুন জীবন পেয়ে বেরিয়ে আসে।
মায়া সভ্যতার মতো চাঁদকে কেন্দ্র এরকম মুখরোচক কাহিনী প্রায় সব জাতির মধ্যেই আছে, এমনকি আমাদের দেশেও আছে (তোমরা কি জানো সেই কাহিনী, না জানলে আজকেই দাদিকে জিজ্ঞাসা করো)। তবে সময়ের সাথে সাথে কাহিনীরও ভোল পাল্টিয়েছে।
নিকট অতীতের ইতিহাসে মানুষ কল্পকাহিনী অপেক্ষা চাঁদের আকার, আকৃতি, ধরণ ইত্যাদি নিয়েই বেশি মাথা ঘামিয়েছে। নিকট অতীতে এমনকি ৪০০ বছর আগেও মানুষের কাছে চাঁদে যাবার বা পৃথিবী থেকে চাঁদকে ভালোভাবে দেখার কোন উপায় আবিষ্কৃত হয়নি। তখন মানুষের কাছে নিছক চোখে দেখে অনুমান করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।
তোমাকে যদি বলি পৃথিবী স্থির নাকি চাঁদ? যদি মহাকাশবিদ্যা সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান না থাকে তাহলে তুমি একবাক্যে বলবে- পৃথিবী। কারণপৃথিবী স্থির না হলে আমরা কীভাবে স্থির হয়ে আছি? আর দিনে রাতে সূর্য-চন্দ্রের মুভমেন্ট তো খালি চোখেই দেখা যায়।
ঠিক আগেকার মানুষরাও শতাব্দীর পর শতাব্দী তোমার মতোই চিন্তা করেছে। আগেকার দিনে পৃথিবী, চাঁদ-সূর্যের অবস্থান নিয়ে দুইটি মতবাদ প্রচলিত ছিল।
১। পৃথিবীকেন্দ্রিক/জিওসেন্ট্রিক (Geocentric)- এ জগতের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পৃথিবী আর চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-তারা সব কিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
২। সূর্যকেন্দ্রিক/হেলিওসেন্ট্রিক (Heliocentric)- এ জগতের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সূর্য আর চন্দ্র, পৃথিবী, গ্রহ-তারা সব কিছু সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
চিত্র-১: পৃথিবীকেন্দ্রিক বনাম সূর্যকেন্দ্রিক মডেল
অ্যারিস্টটল (Aristotle), টলেমির (Ptolemy) মতো বিখ্যাত পণ্ডিতগণও জিওসেন্ট্রিক মতবাদে বিশ্বাস করতো আর মনে করতো পৃথিবী হলো স্থির কেন্দ্র আর চাঁদ-সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এবং এ থিওরি ঐ সময় এত জনপ্রিয় ছিল যে এর বাইরে কেউ চিন্তা করলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করা হতো।
ব্যাপারটা শুধু হাসাহাসির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ঠিক ছিল কিন্তু এটা স্বাভাবিক জল্পনা-কল্পনা আর হাসি-ঠাট্টার গণ্ডি পেরিয়ে ধর্মীয় অনাচারের একটা ভয়ানক রূপ নিয়েছিল। আচ্ছা বলতো তুমি যদি মনে কর পৃথিবী স্থির আর চাঁদ ঘুর্ণায়মান, তাহলে কি তোমাকে কেউ কাটবে না মারবে? আর কারই বা মারা উচিত? এতে কার কি যায় আসে?
কিন্তু আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে কিছু মানুষের ছিল। আর তারা হলো রোমান ক্যাথলিক, খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে একটি গ্রুপ এবং সম্ভবত সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী গ্রুপ। আজকের ইউরোপ আর পশ্চিমা বিশ্বে মাঝে মাঝে উগ্র ধর্মবিদ্বেষী মানুষ দেখা গেলেও সার্বিকভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা অনেক বেশি।
সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম পালন করতে করতে পারে এমনকি নাস্তিকও হতে পারে। রাষ্ট্র এসব ব্যাপারে খুব একটা হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু ইতিহাস এরকম ছিল না। বিশেষ করে ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পূর্বে চার্চ আর ক্যাথলিকদের এতই দাপট ছিল যে সামান্য মতবিরোধের কারণে তারা অবলীলায় মানুষ খুন করতে কুণ্ঠাবোধ করতো না।
অন্য ধর্মের মানুষ তো দূরের কথা নিজদের ধর্মেরই ভিন্নমতের মানুষদের কসাই এর মতো খুন করা হতো। বলছি খ্রিস্টান ধর্মের দুই গ্রুপ রোমান ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টদের কথা− যারা একে অন্যের রক্ত পান করতেও কুণ্ঠাবোধ করতো না।
রোমান ক্যাথলিকদের প্রাপ্ত বাইবেল আর অ্যারিস্টটল/টলেমির জনপ্রিয় ধারণা মিলে যাওয়ায় ক্যাথলিকগণ উহাকে ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন। এবং এর বাইরে কেউ চিন্তা করলে তাকে ধর্মদ্রোহী সাব্যস্ত করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান এমনকি নির্মমভাবে প্রাণহানি করা হয়েছে।
অর্থাৎ ঐ সময় কেউ যদি বলে যে, চাঁদ-সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে না আর গীর্জার লোকেরা তা জানতে পারে তাহলে নির্ঘাত ক্রুশবিদ্ধ করা হবে। যেমন : জর্ডানো ব্রুনো (Giordano Bruno) নামক একজন ইতালিয়ান দার্শনিক ও বিজ্ঞানীকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
এমনকি জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও যাকে আধুনিক পদার্থবিদ্যার জনক বলা হয় তাকেও ১০ বছর কারান্তরীণ করে রাখা হয় চার্চের ভুল তত্ত্বের বিরোধীতা করার কারণে। যদিও ব্রুনো বা গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানীরা চার্চের আক্রোশের শিকার হয়েছিলেন কিন্তু তাদের মতবাদগুলো কিন্তু অনেক আগে থেকেই চলে আসছিল।
চার্চের মতবাদের বিরুদ্ধে প্রথম যিনি মুখ খুলেছিলেন বলে ধারণা করা হয় তিনি হলেন গ্রিক পণ্ডিত এনেক্সাগোরাস (Anaxagoras)− যার জন্ম সক্রেটিসেরও আগে (যীশুর জন্মের প্রায় ৪৫০ বছর আগে)। ধারণা করা হয় তিনিই প্রথম অনুমান করেছিলেন যে চাঁদের নিজস্ব আলো নেই। এনেক্সাগোরাসকেও তার এ মতবাদের কারণে চার্চ কর্তৃক কারাদন্ড এমনকি নির্বাসন দেয়া হয়।
পৃথিবীর পরিবর্তে সূর্যকে আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র বলে প্রথম যিনি দাবি করেন তিনি হলেন আরেক গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টার্কাস (Aristarchus)− যিনি যিশু খ্রীস্টের জন্মের ২৫০ বছর আগে এ মতবাদ দিয়েছিলেন। অ্যারিস্টার্কাস পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বও খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন যদিও তা পরে ভুল প্রমাণিত হয়।
পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব সর্বপ্রথম সঠিকভাবে পরিমাপ করেন মুসলীম বিজ্ঞানী হাবাশ আল-হাসিব আল-মারওয়াযি। তিনি ৮৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চাঁদের ব্যাস এবং পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব প্রায় নিখুঁতভাবে পরিমাপ করেন।
আরেক মুসলিম বিজ্ঞানী হাসান ইবনে আল-হাইসাম যিনি ইউরোপে আল-হাজেন নামে পরিচিত, তাকে ‘আলোকবিদ্যার জনক’ বলা হয়। অনেকে তাকে ‘দ্বিতীয় টলেমি’ও বলে থাকে। হাসান ইবনে হাইসাম ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সর্বপ্রথম পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে চাঁদের নিজস্ব আলো নেই বরং তা সূর্যের প্রতিফলিত আলো মাত্র।
এ বিষয়টা পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ তায়ালা সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা একাধিকবার সূর্য এবং চাঁদকে ভিন্ন নামে উল্লেখ করেছেন। চাঁদকে বলা হয়েছে নুর বা মুনির যার অর্থ হলো আলো বা প্রতিফলিত আলো আর সূর্যকে বলা হয়েছে সিরাজ যার অর্থ হলো প্রদীপ যা অন্যকে আলোকিত করে (রেফারেন্স− আল-কোরআন : ১০-৫, ৭১-১৬, ২৫-৬১, ৭৮-১৩)।
উল্লেখ্য, কোরআন অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয় ৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এর আগে কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে চাঁদের আলো প্রতিফলিত রূপ। যদিও কিছু গ্রিক বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিল কিন্তু অজ্ঞ আরবজাতির কাছে সেই ধারণা পৌঁছাবার কোন পথ ছিল না।
চিত্র-২ : ইউরোপিয়ানদের তৈরি হাসান ইবনে আল-হাইসামের প্রতিকৃতি
যাহোক, কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরবর্তীকালে অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী মুসলিম বিজ্ঞানীদের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এসময় বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি হয় তা ইতিহাসের আর কোন সময়ে হয় নি। এ সময়ে মুসলিম বিশ্ব ছিল সারা দুনিয়ার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু।
আজকে যেমন আমরা উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি জমাই, তখনকার দিনে সারা দুনিয়া থেকে মানুষ আরবে যেতো জ্ঞান অর্জন করার জন্য। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সিংহভাগ জিনিসের গোড়াপত্তন হয়েছিল ঐ সময়ে।
কিন্তু আমরা এ সময়ের কথা বা তখনকার বিজ্ঞানীদের কথা তেমন শুনি না, তাদের আবিষ্কার সম্পর্কেও তেমন কিছু না। সবকিছুর আবিষ্কারক হিসেবে কেবল ইউরোপিয়ানদের নাম শুনি। এর বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো- ঐ সময়ে মুসলিম বিজ্ঞানীদের রচিত সমস্ত বৈজ্ঞানিক কিতাব, আবিস্কার এবং জীবিত বিজ্ঞানীরদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিল চেঙ্গিস খান/হালাকু খানদের মোঙ্গল/তাতার বাহিনী।
উদাহরণস্বরূপ, হালাকু খানের বাহিনী বাগদাদের ‘হাউজ অফ উইজডম’ নামক জগতবিখ্যাত লাইব্রেরির সমস্ত বই কয়েক মাস ধরে পোড়ায় এবং কিছু বই টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেয়। শুধু পানিতে ফেলে দেয়া বইয়ের পরিমাণ এত বিশাল ছিল যে বিশাল টাইগ্রিস নদীর পানি বইয়ের কালিতে কালো রঙ ধারণ করেছিল।
চিত্র-৩: বাগদাদের হাউজ অফ উইজডম
এর দ্বিতীয় কারণ হলো, স্বর্ণযুগ পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের জ্ঞানচর্চার প্রতি অনীহা। চেঙ্গিস খানের ধ্বংসলীলার পর মুসলিমবিশ্ব এতবেশি যুদ্ধবিগ্রহ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হয় যে আজ পর্যন্ত জ্ঞানচর্চার সেই স্বর্ণযুগ আর ফিরে আসেনি।
যাহোক, গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আরও বেশ কয়েকটি কারণ আমরা খুঁজে পাবো। আজ এ পর্যন্তই। আগামী পর্বে ইবনে হাইসামের পর থেকে আবার চাঁদ মামার গল্প বলা শুরু করবো। সে পর্যন্ত ভালো থেকো।
মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১
No Comment