।আন্দালিব অপু।
কখনো ভেবে দেখেছো কি তোমার চেহারা কেনো তোমার বাবা মায়ের সাথে মিলে? যমজ বাচ্চা দেখতে কতো কিউটই না লাগে; যমজ হওয়ার পেছনে রহস্যটা কি? মানুষের ক্যান্সার হয় কেনো? কিছু কিছু মানুষের চুল লাল হয় কেনো?
এই সব কিছুর পেছনে আছে জিনের প্রভাব। না, কোনো জিন-ভূত না। ‘GENE’ হলো জীবন্ত প্রাণের বংশগতির আণবিক একক। আমাদের দেহ কোষ দিয়ে গঠিত। কোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু ক্রোমোজোম— যা DNA দিয়ে গঠিত। এই DNA-এর নির্দিষ্ট অংশই হলো GENE।
DNA-এর নির্দিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট সব বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। মূলত এর কারণেই আমাদের বাহ্যিক রকমফের হয়। আর এর সম্পর্কিত বিষয়াদি হলো জেনেটিক্স। আর এই জেনেটিক্স সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা দেন ‘গ্রেগর জোহান মেন্ডেল’। উপরের সব গুলো প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব জেনেটিক্সের মাধ্যমে।
এই লেখায় আমরা জেনেটিক্স সম্পর্কিত মজার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানবো…।
আমাদের রক্তের গ্রুপ কেনো আলাদা?
“যুদ্ধ অনেক, রক্ত অনেক”— খুব প্রাচীন এক গ্রিক প্রবাদ। প্রবাদটি সুন্দর হলেও আংশিক ভুল। আমরা মোটামুটি সবাই জানি রক্তের বিভিন্ন ভাগ আছে। সবচেয়ে পরিচিত ভাগ হলো ‘A, B, AB, O’ Blood Group System। আমাদের সবার রক্তই এই চারটি গ্রুপের কোনো না কোনো একটির অন্তর্ভুক্ত।
আমাদের রক্তের গ্রুপ কি হবে তা নির্ভর করে আমাদের শরীরে কোনো ধরনের অ্যান্টিজেন আছে তার ওপর। অ্যান্টিজেন হলো একধরনের প্রোটিন— যা লোহিত রক্তকণিকার বাইরে অবস্থান করে শ্বেত ও প্রতিরক্ষা কণিকার সাথে সংযোগ স্থাপন করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
আমাদের রক্তের লোহিত রক্ত কণিকা সর্বোচ্চ দুটি অ্যান্টিজেন ধরতে পারে। যে অ্যান্টিজেন থাকে, অ্যান্টিবডি থাকে তার বিপরীত। A ব্লাড গ্রুপে অ্যান্টিজেন থাকে, অ্যান্টিবডি থাকে B। আবার, B ব্লাড গ্রুপে তার বিপরীত ঘটনা হয়। AB ব্লাড গ্রুপে A, B দুটো অ্যান্টিজেন থাকলেও কোনো অ্যান্টিবডি নেই। O গ্রুপে কোনো অ্যান্টিজেনই থাকে না।
বংশানুক্রমিকভাবে আমাদের দেহে এক সেট জিন আসে আমাদের বাবা থেকে, অন্য সেট আসে আমাদের মা থেকে। আমাদের দেহে কোন ধরনের অ্যান্টিজেন থাকবে তা নির্ভর করছে আমাদের বাবা মা থেকে কোন সেটের জিন আসছে তার ওপর।
দুই সেট জিনের মধ্যে যেকোনো একটি অন্যটির চেয়ে বেশি সক্রিয়। সক্রিয় জিনটি প্রকাশ পায়, অন্য জিনটি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। যেমন : A অ্যান্টিজেনের দুই সেট মিলে A ব্লাডগ্রুপ সৃষ্টি করবে, A অ্যান্টিজেনের দুই সেট মিলে B ব্লাডগ্রুপ সৃষ্টি করবে, একটি A অ্যান্টিজেন ও B একটি অ্যান্টিজেন মিলে AB ব্লাডগ্রুপ সৃষ্টি করবে।
ধারণা করা হয়, A ও B ব্লাডগ্রুপের মিউটেশনে O ব্লাডগ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর ভৌগলিক কারণে অঞ্চল ভেদেও মানুষের রক্তের গ্রুপ ভিন্ন হয়ে থাকে। এক তত্ত্ব অনুযায়ী, A ব্লাড গ্রুপের সূচনা হয় ইউরোপে, B ব্লাড গ্রুপের সূচনা হয় এশিয়ায়, O ব্লাড গ্রুপের সূচনা হয় দক্ষিণ আমেরিকায় এবং মাইগ্রেশনের ফলে সব স্থানেই সব ধরনের রক্তের গ্রুপ পাওয়া যায়।
যমজ বাচ্চা কেন হয়?
Fraternal Twin— সন্তান ছেলে বা মেয়ে হওয়াটা সম্পূর্ণভাবে পুরুষের ওপর নির্ভর করলেও যমজ সন্তান হওয়াটা নির্ভর করে নারীর ওপর। নারীর পরিবারে বা নিকট আত্মীয়র যদি পূর্বে কোনো যমজ থেকে থাকে, তবে জিনগত কারণে ৫০ বা তার বেশি শতাংশ সম্ভাবনা থাকে যে ঐ নারী ও যমজ সন্তান জন্ম দিবে।
চিত্র-২.১
এ ধরনের যমজ হলো Fraternal Twin। দুটি ভিন্ন ডিম্বাণু নিষিক্তকরণে এদের জন্ম হয়।ঋতুচক্রে আকস্মিকভাবে মাতৃগর্ভে থাকা দুটি ডিম্বাণু আলাদা আলাদা দুটি শুক্রাণু নিষিক্ত হয়ে গেলে একই সাথে দুটি শিশুর জন্ম হতে পারে।
যমজ হলেও এদের দেখতে এক রকম হয় না, এদের ব্লাড গ্রুপ এক রকম হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। এইক্ষেত্রে দুটি সন্তানই ছেলে বা দুটিই মেয়ে কিংবা একটি ছেলে অন্যটি মেয়ে হতে পারে। এই ধরনের যমজ হওয়ার কারণ জেনেটিক্যাল।
Identical Twin— এ ধরনের যমজ বাচ্চাদের চেহারা একই রকম হয়। মাতৃগর্ভে থাকা নিষিক্ত ভ্রুণ মাঝে মাঝে কোনো এক অজানা কারণে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই দুটি ভ্রূণ থেকে যখন দুটো বাচ্চা হয়, তারা দেখতে একই রকম হয়।
কারণ তারা একই ভ্রূণ দুজনে মিলে শেয়ার করে। এ ধরনের যমজ হওয়ার প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। বলা যায়, সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। সাধারণত, Identical Twin-দের চেহারা, ব্লাড গ্রুপ, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সব এক হলেও মাঝে মাঝে বৈচিত্র্য দেখা দেয়।
এদের ডিএনএ একই ধরনের জিন বহন করলেও সব সময় দুইজনের দেহেই জিনগুলোর বৈশিষ্ট্য সমভাবে প্রকাশ পায় না। একটি জিন প্রকাশ পাবে কি না তা নির্ধারণ করে দেয় জিনের বাইরে অবস্থান নেয়া প্রোমোটার— যা একটি সুইচের মতো কাজ করে।
আর এই সুইচ কে অন করে কিছু সিগন্যাল (যেমন : বাইরের পরিবেশ)। ধরা যাক, ছোট বেলায় দুই Identical Twin-কে দুটি ভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হলো। দুটি ভিন্ন দেশের পরিবেশ দুটো ভিন্ন ধরনের সিগন্যাল দিবে, ফলে যমজ দুইজনে সামঞ্জস্য দেখা দিবে।
বাংলাদেশে জন্ম নেয়া কোনো শিশুকে যদি জাপানে নিয়ে সেখানে লালন পালন করা হয় তবে ঐ শিশুটির মধ্যে জাপানিজ বৈশিষ্ট ফুটে উঠবে, এমনকি তার চেহারা ও জাপানিজ মনে হবে।
আমাদের ডিএনএ কি সব সময়ই একই থাকে?
আমাদের সকল বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট ডিএনএ-এর ভেতর লেখা থাকে। আমাদের ডিএনএ কি পরিবর্তিত হয়? না, আমাদের ডিএনএ সব সময় একই রকম নাও থাকতে পারে। প্রতি মুহূর্তেই আমাদের দেহে কোষ বিভাজন হচ্ছে, অর্থাৎ একটি কোষ হতে দুটি কোষ, দুটি থেকে চারটি কোষ বিভাজিত হচ্ছে।
এই কোষ বিভাজনের ফলে কোষের ডিএনএগুলোও বিভাজিত হচ্ছে। অর্থাৎ, একটি ডিএনএ হতে দুটি ডিএনএ, দুটি থেকে চারটি ডিএনএ বিভাজিত হচ্ছে। একে বলা হয়, ডিএনএ রেপ্লিকেশন। ডিএনএ-এর ভেতরে চার ধরনের লেটার (A, T, G, C) দিয়ে কোড লেখা থাকে।
এই চারটি লেটার হলো চার ধরনের কেমিক্যাল। এই কেমিক্যালগুলো দিয়েই আমাদের জিন সাজানো থাকে। মানবদেহে এই কেমিক্যালগুলো আছে ৩.২ বিলিয়ন বার। অর্থাৎ একবার ডিএনএ রেপ্লিকেশন করতে হলে ৩.২ বিলিয়ন কেমিক্যালকে রেপ্লিকেট করতে হয়।
কিন্তু এতে সমস্যা হলো, প্রতিবার রেপ্লিকেশনে কিছু ERROR/ভুল হয়। এই ERROR-কে বইয়ের ভাষায় বলে MUTATION। হিসাব করে দেখা গেলো, প্রতি ১০৮ বার কেমিক্যাল রেপ্লিকেশনে একটি করে ভুল হয়। ৩.২ বিলিয়ন বার কেমিক্যাল রেপ্লিকেশনে মোট ভুল সংখ্যা হয় ৩০-এর কাছাকাছি।
অর্থাৎ, একবার ডিএনএ রেপ্লিকেশনে ভুল হয় ৩০টির মতো। একটি কোষ থেকে যখন নতুন একটি কোষ সৃষ্টি হয় তখন ভুল সংখ্যা হয় ৩০, নতুন কোষটি যখন আবার বিভাজিত হয় তখন আরো ৩০টি ভুল করে, এভাবে প্রতিবার কোষ বিভাজনে ভুলের সংখ্যা বাড়তেই থাকে।
ভুল করতে করতে যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনের কোড পরিবর্তন হয়ে যায়, তখন আমাদের দেহে ক্যান্সারসহ অন্যান্য জটিল রোগ দেখা দেয়। সুতরাং, আমাদের ডিএনএ সব সময়ই একই থাকে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের ডিএনএ-তে মিউটেশন হয়।
মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১
https://www.byapon.com/2023/technology/vpn-ki-o-keno.html
No Comment