।মো. সোহাগ হাসান।
শিক্ষার্থী, ইনষ্টিটিউট অফ লেদ্যার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তোমরা যখন রাতের অন্ধকার আকাশে তাকাও, ফুটফুটে উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো তোমাদের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগিয়ে তুলে। মনে হয় না, এই উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে না? কিন্তু কি করে! নক্ষত্রগুলোতো অনেক দূরে। তোমাদের মনে প্রশ্নও জাগে এই নক্ষত্রগুলো কত দূরে এবং কী ভাবে নক্ষত্রের এই দূরত্ব নির্ণয় করা হয়?
প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। কেননা কৌতূহলী মন অনেক কিছুই জানতে চায়। জানার অদম্য ইচ্ছেই তোমাদেরকে সৃষ্টিকর্তার এই সুন্দর সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটনে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আজ,তোমাদের বলবো উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব কি ভাবে নির্ণয় করা যায়?
এর আগে তোমাদের Astronomical distance বা জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত দূরত্ব সম্পর্কে একটু বলি। তা হলে বিষয়টি একটু সহজে বুঝতে পারবে এবং জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত দূরত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবে। সূর্যের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টোরি। এটি আলফা সেন্টোরি ত্রি-নক্ষত্র সিস্টেমের অংশ। বলতে পারো তোমাদের কাছ থেকে এই নক্ষত্রের দূরত্ব কত হতে পারে?
সূর্য হতে নিকটতম এই নক্ষত্রটির দূরত্ব ৪০ ট্রিলিয়ন কি.মি (১ ট্রিলিয়ন = ১০৩ বিলিয়ন কি.মি আর ১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি )। বিশাল এই দূরত্ব সাধারণ স্কেল দ্বারা পরিমাপ করা অচিন্তনীয় ব্যাপার! তাই এই বিশাল দূরত্ব নির্ণয় করা হয় Light years বা আলোকবর্ষ এককে।
এই আলোকবর্ষ একক কি! ভাবতে হবে না আমিই বলে দিচ্ছি। আলো ৩×১০৮ m/s বেগে (যেখানে সর্বোচ্চ গতি সম্পন্ন বুলেট ট্রেনের বেগ প্রতি সেকেন্ডে ১৬৭.৫ মিটার অর্থাৎ ১৬৭.৫ m/s) এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে এক আলোকবর্ষ বলে। সূর্য থেকে আলফা সেন্টোরি নক্ষত্রটির দূরত্ব প্রায় ৪.২৫ আলোকবর্ষ।
তোমাদের একটু বুঝিয়ে বলি, কোন বস্তুকে যদি আলোর গতিতে আলফা সেন্টোরি নক্ষত্রে পাঠাই বস্তুটি নক্ষত্রটিতে পৌঁছাতে ৪ বছরেরও বেশি সময় লাগব। আর যদি জেট বিমান পাঠাই কতো সময় লাগতে পারে পৌঁছাতে? শুনে একটু অবাক হতেই পারো, জেট বিমানটি নক্ষত্রটিতে পৌছাতে ৫ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন = ১০ লাখ) বছর লাগবে। কি চমকে গেলে!
চল জেনে নিই কী করে এই দূরত্ব নির্ণয় করা হয় :
তিনটি উপায়ে আমরা নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয় করতে পারি। আজ শুধু প্যারালাক্স পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা করব। তোমাদের আগে জানতে হবে প্যারালাক্স কী? বৃদ্ধাঙ্গুলিটা তোমাদের নাকের একটু সামনে ধরে ডান চোখ বন্ধ করে, বাম চোখে আঙ্গুলটির দিকে লক্ষ করো।
তার একটু পর বাম চোখ বন্ধ করে ডান চোখে আঙ্গুলটির দিকে লক্ষ করো। কী দেখলে? আঙ্গুলের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে? যদিও পরিবর্তন তেমন বেশি নয়। তবে এই পরিবর্তনের কারণ, ডান চোখ থেকে বাম চোখের মাঝের দূরত্ব।
আর এই বিষয়টিই প্যারালাক্স। আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করি। তোমরা গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালে দেখবে, রাস্তার পাশের গাছগুলো খুব দ্রুত পিছনে সরে যাচ্ছে মনে হবে। কিন্তু দূরের পর্বত বা গাছের দিকে লক্ষ করলে মনে হবে এগুলো একটু আস্তে পিছনে সরে যাচ্ছে।
এর কারণ, তোমাদের কাছ থেকে রাস্তার পাশের গাছ এবং পর্বতের দূরত্ব সমান নয়। ঘটনাটি এমন মনে হচ্ছে দূরত্বের তারতম্যের কারণে। সুতরাং, এ বিষয়টিও প্যারালাক্স। চিত্রটি লক্ষ করি।
চলে আসি আমাদের মূল প্রসঙ্গে, প্রথমত রাতের অন্ধকারে আকাশের বুকে টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের অবস্থান লক্ষ করো। তারপর, ৬ মাস পর ঐ নক্ষত্রটির অবস্থান পুনরায় লক্ষ কর। তোমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে তাই ৬ মাস পর পৃথিবীর অবস্থান হবে সূর্যের অপর পৃষ্ঠে ঠিক পৃথিবীর আগের অবস্থান বরাবর।
মনে পরে কি প্যারালেক্সের কথা? প্যারালাক্স প্রভাবের কারণে, তারকা/নক্ষত্রটির অবস্থান রাতের আকাশে একটু পরিবর্তন হয়। নক্ষত্রের এই পরিবর্তনকে স্টেলার প্যারালাক্স বলা হয়। পৃথিবীর দুটি অবস্থান পরিবর্তন তুলনা করে পরে প্যারালাক্স কোণ গণনা করা হয়।
প্যারালাক্স কোণ এবং নক্ষত্রের দূরত্বের মধ্যে একটি সুন্দর ত্রিকোণমিতি সম্পর্ক রয়েছে। সমীকরণটি হলো,
d=1/p
d= নক্ষত্রের দূরত্ব
p= প্যারালাক্স কোণ
সমীকরণটির পেছনের গণিতটি তোমাদের একটু বলার চেষ্টা করি। নক্ষত্রটির দূরত্ব গণনা করার জন্য, সূর্যের অবস্থান থেকে তারকা/নক্ষত্র পর্যন্ত একটি লম্বরেখা অংকন করি এবং পৃথিবীর পরিবর্তনীয় দুটি অবস্থান যোগ করি।
ওপরের চিত্রটি লক্ষ করলেই বিষয়টি বুঝতে পারবে। এক্ষেত্রে নক্ষত্রটির অবস্থান পরিবর্তন খুবই কম হয়। তাই প্যারালাক্স কোণকে Arcseconds (ক্ষুদ্র একটি একক) এককে পরিমাপ করা হয়— যা ১ ডিগ্রির ৬০ ভাগ। Arcseconds-কে দূরত্ব পরিমাপের জনপ্রিয় একক পারসেকে পরিবর্তন করলে হবে, ১ parsec=১ AU/Arcseconds। আর ১ পারসেক প্রায় ৩.২৬ আলোকবর্ষের সমান।
ত্রিকোণমিতির সূত্র ব্যবহার করে পাই,
Tan θ = লম্ব/ভূমি
তোমাদের বলে রাখি, θ (থিটা) প্যারালাক্স কোণ; লম্ব হলো পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যকার দূরত্ব এবং ভূমি হলো সূর্য এবং নক্ষত্রের মধ্যবর্তী দূরত্ব। এই সমীকরণ থেকেই d=1/p সম্পর্কটি স্থাপন করা যায়।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৪৯,৫৯৭,৮৭০ কি.মি. বা ১.৫৮ × ১০-৫ আলোকবর্ষ। জেনো রাখো, পৃথিবী থেকে সূর্যের এই দূরত্বকে Astronomical unit সংক্ষেপে AU বা জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত একক বলা হয়। এককটি সৌর জগতের গ্রহের দূরত্ব নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়।
যদিও এখন পারসেক এককটি বেশ জনপ্রিয়। ১ Astronomical unit প্রায় ৪.৮৪৮ × ১০–৬ পারসেক এককের সমান। তা হলে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ৪.৮৪৮ × ১০–৬ পারসেক। তারকার দূরত্ব নির্ণয়ের জন্য এগুলো তোমাদের জানতে হবে। সব কিছুই তোমাদের জানা, এখন সমীকরণে মান বসিয়ে সহজেই নক্ষত্রের দূরত্ব পরিমাপ করতে পারবে।
চিত্র-৪ : d=1/p সমীকরণ প্রতিষ্ঠা
তোমাদের বলে রাখি, আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে নিকটতম তারকা/নক্ষত্র আলফা সেন্টোরি ৪ আলোকবর্ষ দূরে। এর মানে এই যে, সূর্য ব্যতীত ১ পারসেক দূরত্বের মধ্য কোনো নক্ষত্র থাকতে পারে না।
যদিও কখনো তোমরা এই দূরত্বের মধ্যে নক্ষত্রের উপস্থিতি অনুভব করো, তবে তোমাদের মনে রাখতে হবে নক্ষত্রটির প্যারালাক্স কোণ ১ arcseconds থেকে অনেক কম হবে। এতো ক্ষুদ্র প্যারালাক্স কোণ নির্ণয় হতাশাজনকভাবে ভুল হতে পারে।
তোমারা স্কুলে ত্রিকোণমিতি করতে গিয়ে হয়তো কিছুটা বুঝেছো, ক্ষুদ্র কোণগুলো নির্ণয় করা কতটা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্যারালাক্স পদ্ধতিটি শুধুমাত্র বড় পরিসরের প্যারালাক্স কোণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে, যেখানে নক্ষত্রটির প্যারালাক্স কোণ ১ থেকে বড় এবং নক্ষত্রটির দূরত্ব ১০০ পারসেকের মধ্যে হতে হবে।
আজ শেষ করলাম। ভালো থাকো ক্ষুদে বন্ধুরা।
তথ্যসূত্র :
-
Science ABC
মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১
No Comment