।প্রকৌশলী সাব্বির আহমেদ।
তোমরা যারা ইন্টারনেটের দুনিয়ায় নিয়মিত যাতায়াত করো তারা নিশ্চয়ই ভিপিএন শব্দটি শুনেছো। তোমাদের মধ্যে অনেকেই আছো যারা ভিপিএন ব্যবহার করেছো। অনেকে দেখেছো বন্ধুদের ব্যবহার করতে কিন্তু নিজে করোনি। আবার অনেকে এমন থাকতে পারো যারা আজই প্রথম ভিপিএন-এর নাম শুনেছো। সবার জন্যই আজকের এই আলোচনা। তাহলে চলো শুরু করা যাক।
ভিপিএন কী?
ভিপিএন মানে হচ্ছে ব্লক সাইটগুলোতে প্রবেশের একটা ব্যবস্থা। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ ব্লক সাইটে প্রবেশের দরকার হলেই তবে ভিপিএন ব্যবহার করে। ভিপিএন-এর পুরো অর্থ হচ্ছে, ‘ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক’।
যখন একটি পাবলিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একাধিক কম্পিউটারকে বা আলাদা নেটওয়ার্ককে একই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়, তখন তাদের ভিপিএন বলে। নিরাপদ যোগাযোগ এবং ডাটা এনক্রিপ্ট করার একটি পদ্ধতি হিসেবে এটি কাজে লাগে।
এর মানে ভিপিএন তোমার ডিভাইসকে একটি ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারে এবং তোমার পাঠানো সব ডাটা দ্রুততার সঙ্গে এনক্রিপ্ট করে ফেলে অর্থাৎ পাবলিক ডোমেইন থেকে লুকিয়ে রাখে এবং এটা তোমার ব্রাউজিং হিস্টোরির কোনো ট্র্যাক রাখে না।
ভিপিএন কীভাবে কাজ করে?
ভিপিএন তোমার ইন্টারনেট সংযোগকে এনক্রিপ্ট করে তোমার ডিভাইসের আইপি অ্যাড্রেস বদলে দিয়ে অন্য আরেকটি আইপি-তে রূপান্তরিত করে। ভিপিএন তোমার ও তোমার ইন্টারনেট গন্তব্যের মধ্যে একটি ভার্চুয়াল ‘Tunnel’ বা সুড়ঙ্গ তৈরি করে।
তোমার ডিভাইস ও একটি ভিপিএন সার্ভারের মধ্যে সংযোগের পর সৃষ্টি হয় এই সুড়ঙ্গ। ভিপিএন সার্ভারের সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর ঐ সার্ভারই তার এনক্রিপশন প্রোটোকলের মাধ্যমে তোমার গোপনীয়তা নিশ্চিত করে— যার ফলে তুমি কোনো তথ্য আদান-প্রদান করলে তা সুরক্ষিত সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যায়।
এই সুড়ঙ্গকে তুলনা করতে পারো খামে ভরে চিঠি পাঠানোর সাথে। তুমি চিঠিতে কী লিখেছ তা যেমন খাম না ছিঁড়ে দেখা সম্ভব নয়, তেমনি ভিপিএন ব্যবহার করে তুমি কী করছো, কাকে মেসেজ দিয়েছ, কোন সাইটে প্রবেশ করেছো, তা জানাও সহজে সম্ভব নয়।
চিত্র-১ : ভিপিএন কীভাবে কাজ করে
এর ফলে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডর, সরকার এবং হ্যাকার অর্থাৎ, পৃথিবীর কোনো থার্ড পার্টিই তোমার কার্যক্রম মনিটর করতে পারবে না। তুমি এবং তোমার ইন্টারনেট ব্যবহার হবে নিরাপদ।
কেন ভিপিএন ব্যবহার করবে?
আবার খামে ভরা চিঠির উদাহরণে ফিরে যাওয়া যাক। ধরো, তুমি কাউকে চিঠি পাঠাতে চাইছো। চিঠি পাঠানোর জন্য একজন লোকও যোগাড় করেছো। কিন্তু চিঠিটা খামের ভেতরে না ঢুকিয়ে দিয়ে দিলে সে লোকের কাছে। এখন সে লোকটি চাইলেই কিন্তু তোমার চিঠি পড়ে দেখতে পারে।
এই লোকটির মতোই কাজ করতে পারে তোমার ISP। চাইলেই দেখতে পারে তুমি কী কী করছো ইন্টারনেটে। তাই সেই সমস্যা থেকে বাঁচতে চাইলে ভিপিএন ব্যবহার করো। আবার তোমরা অনেকেই ভাবতে পারো তোমার ISP খুবই বিশ্বস্ত। এটি ভাবা দোষের নয়।
কিন্তু একটি ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, ISP নিজে থেকে না চাইলেও অন্য কারোর হস্তক্ষেপে তোমাকে নজরদারিতে রাখতে পারে কিংবা তোমার তথ্য চুরি করতে পারে। তাই আগে থেকে সতর্ক থাকা হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
সবসময় ভিপিএন ব্যবহার না করলেও অন্তত ব্যক্তিগত কিংবা গোপনীয় কোনো তথ্য আদান-প্রদান করার সময় ভিপিএন ব্যবহার করবে। বিশেষ করে অনলাইনে লেনদেন করার সময়ও ভিপিএন ব্যবহার করা জরুরি। এ ছাড়াও আরেকটি ব্যাপারে না বললেই নয়। তা হলো পাবলিক ওয়াইফাই। ফ্রি জিনিসের পেছনে কমবেশি আমরা সবাই ধাওয়া করে বেড়াই! তাই ফ্রি ওয়াইফাইও এর ব্যতিক্রম নয়।
আমরা অনেকেই ফ্রি ওয়াইফাই এর নাগাল পেলে নিরাপত্তার কথা না ভেবেই ব্যবহার করা শুরু করে দিই। কিন্তু এসব নেটওয়ার্কেই তথ্য চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবথেকে বেশি। তাই এসব নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার সময় ভিপিএন ব্যবহার করা সবথেকে সহজ ও নিরাপদ পন্থা!
চিত্র-২ : তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য বসে আছে হ্যাকার আর গোয়েন্দারা
নিরাপত্তার ব্যাপার তো আছেই। এসব ছাড়াও কোনো ওয়েবসাইট আনব্লক করার ক্ষেত্রে ভিপিএন ব্যবহার করতে পারো। অর্থাৎ, তোমার ISP যদি কোনো ওয়েবসাইটে তোমাকে প্রবেশ করতে না দেয়, ভিপিএন ব্যবহার করে তুমি সহজেই সেখানে প্রবেশ করতে পারবে।
আবার যদি তোমার ISP-এর দেওয়া আইপি অ্যাড্রেস এর বদলে অন্য কোনো জায়গার আইপি অ্যাড্রেস দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চাও, তাহলে সেটিও ভিপিএন ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভব। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো আমরা প্রায়ই বিভিন্ন কলিং অ্যাপের (ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপ ইত্যাদি) মাধ্যমে ভিডিও চ্যাট করি।
এর মাধ্যমে আমরা খুব কম খরচে আনলিমিটেড কথা বলতে পারি। তাই এসব অ্যাপ খুব জনপ্রিয়। তুমি যখন তোমার ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে কথা বলবে, তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না সেই কথাগুলো অন্য কেউ রেকর্ড করুক এবং তা পাবলিক হয়ে যাক। যদি তুমি তোমার ভিডিও ও অডিও চ্যাটিং প্রকাশিত হোক না চাও তবে অবশ্যই ভিপিএন ব্যবহার করবে।
কিছু কিছু কন্টেন্ট বিভিন্ন লোকেশন থেকে ব্রাউজ করা যায় না। এরকম ভিডিও ও অডিও স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে নির্দিষ্ট দেশের জন্য স্পেসিফিক কন্টেন্টগুলো যে কোনো দেশ থেকেই ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন)-এর মাধ্যমে ব্রাউজ করতে পারবে।
যেমন ধরো স্পটিফাই সাইট থেকে বাংলাদেশে বসে তুমি গান শুনতে পারবে না। কিন্তু চাইলেই ইউএস বা অন্য কোন দেশ যেখানে স্পটিফাই-এর সার্ভিস আছে সেসব দেশের আইপিযুক্ত সার্ভারে ভিপিএন দিয়ে কানেক্ট করে তুমিও স্পটিফাই সার্ভিস বাংলাদেশে বসেই ব্যবহার করতে পারবে।
বিভিন্ন ওয়েবসাইটের ট্র্যাকিং থেকে বাঁচতে তুমি যদি তোমার প্রকৃত লোকেশন গোপন রেখে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চাও তাহলে ভিপিএন তোমাকে সেই সুবিধা দিবে। এ ছাড়া ব্লকড ওয়েবসাইট ব্রাউজ করতে চাইলেও ভিপিএন ব্যবহার করতে হবে।
তোমরা হয়তো জানো যে, চীনে সরকারিভাবে অনেক সাইটই বন্ধ করে রাখা আছে (এমনকি ফেসবুকও)। চাইনিজরা ভিপিএন ব্যবহার করে প্রয়োজন পড়লে সেসব সাইট ব্রাউজ করে পুরো ইন্টারনেট এর সাথে সংযুক্ত থাকে।
ভিপিএন ব্যবহার করা কি বেআইনি?
এতক্ষণ ধরে ছদ্মবেশ, ওয়েবসাইট আনব্লক ইত্যাদি অনেককিছু নিয়েই কথা বললাম। তাই প্রশ্ন আসতেই পারে, এটি কি বেআইনি নয়? এককথায় বললে, না! ভিপিএন হলো তোমার ব্যক্তিগত তথ্য কিংবা গোপনীয়তা গোপন রাখার একটি উপায় মাত্র। তবে তুমি যদি ভিপিএন ব্যবহার করে কোনো বেআইনি কাজ করো, তাহলে সেটি অবশ্যই বেআইনি!
ভিপিএন কি বিশ্বাসযোগ্য?
ভিপিএন তো তোমাকে একটি অসৎ ISP থেকে রক্ষা করতে পারে, হ্যাকারদের থেকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু এমন কি হতে পারে না, সেই ভিপিএন প্রদানকারী কোম্পানিই তোমার তথ্য চুরি করা শুরু করলো? এমনটা হতেই পারে! কিন্তু সেটা তখনই হবে যখন তুমি একটি অসৎ ভিপিএন প্রদানকারী কোম্পানির অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করবে।
তুমি যখন ভিপিএন ব্যবহারের জন্য সফটওয়্যার খুঁজতে যাবে, তখন দেখবে এসব সফটওয়্যারের সংখ্যা অসংখ্য। অনেকগুলো কোম্পানিই বিনামূল্যে সীমাহীন ভিপিএন ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে থাকে। আবার অনেককে তাদের ভিপিএন সার্ভিস ব্যবহারের জন্য টাকা দিতে হয়।
তাই স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে— এসব দেখেই ছুটে চলে যাবে না। আগে জানার চেষ্টা করবে ভিপিএন সার্ভিস প্রদানকারী কতটুকু বিশ্বস্ত। সেজন্য ওয়েবে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করো, একটু গুগল মামাকে জিজ্ঞাসা করে জানার চেষ্টা করো কোন ভিপিএন প্রদানকারী কোম্পানি তোমাকে কী কী সুবিধা দিচ্ছে? তাদের রিভিউ কেমন? লাস্ট ইয়ারে কোন ভিপিএন কোম্পানিগুলো সিকিউরিটির দিক থেকে সেরা অবস্থানে ছিলো? ইত্যাদি।
ফ্রি ভিপিএন ব্যবহার করা কি নিরাপদ?
কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিএসআইআরও) সাম্প্রতিক এক গবেষণা করেছে। তারা ২৮৩ টি ভিপিএন অ্যাপ ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি এবং সিকিউরিটি নিয়ে গবেষণা করে। ফলাফল হচ্ছে, ৭৫% অ্যাপ থার্ড পার্টি ট্র্যাকিং টুল ব্যবহার করে— যার মাধ্যমে তোমার তথ্য চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
চিত্র-৩ : ফ্রি ভিপিএন বনাম পেইড ভিপিএন
অন্যদিকে, ৮২% অ্যাপ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্যের জন্য অনুমতি চায়, যার ফলে তোমার ইউজার নাম কিংবা পার্সওয়াড চুরি হতে পারে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, তারা ৩৮% অ্যাপে ভাইরাসের উপস্থিতি পেয়েছে।
কিছু জনপ্রিয় ফ্রি ভিপিএন যেমন-ভিপিএন ফ্রি, রকেট ভিপিএন, টাইগার ভিপিএন, সাইবারগোস্ট এবং ইজিওভিপিএন যেগুলো কয়েক লক্ষবার ডাউনলোড করা হয়েছে সেগুলোতেও ভাইরাস পাওয়া গেছে।
ফ্রি ভিপিএন কি সত্যিই ফ্রি?
না। কোনো ভিপিএন সেবাদাতা কোম্পানিই তোমাকে সম্পূর্ণ ফ্রিতে সার্ভিস দিবে না। একবার ভাবো তো, কেন কেউ তোমাকে একদম ফ্রিতে সেবা প্রদান করবে? তাও যতদিন ইচ্ছা ততদিন। এতো ভালো আর পরোপকারী নিশ্চয় কেউ নেই।
তুমি যদি টাকা দিয়ে না কিনে থাকো, তার মানে তুমি অন্য কোনোভাবে তাদের মূল্য পরিশোধ করছো। ফ্রি ভিপিএন এর মাধ্যমে কী কী ক্ষতি হতে পারে জেনে নেওয়া যাক।
১। তোমার ডাটা ট্র্যাক করে বিক্রি করে দেয় : ভিপিএন তোমার আইএসপি পরিবর্তন করে ফেলে। যার ফলে তুমি অনলাইনে কি করছো তা দেখা যায় না, কিন্তু ভিপিএন প্রোভাইডার যারা, তারা ঠিকই তোমার তথ্য ট্র্যাক করে। তোমার তথ্য কালেক্ট করে সেগুলো বিভিন্ন অ্যাড আজেন্সির কাছে বিক্রি করে দেয়।
২। ম্যালওয়ার : ম্যালওয়ার প্রবেশ করানো বর্তমানে একটা কমন ঘটনা। আর ভিপিএন ব্যবহার করার মাধ্যমে এটা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। এসব ম্যালওয়ার তোমার সংবেদনশীল ডাটা যেমন : ইউজার নাম কিংবা পাসওয়ার্ড চুরি করে।
৩। ব্যান্ডউইথ চুরি : ভিপিএন-এর মাধ্যমে তোমার ব্যান্ডউইথ চুরি হতে পারে। আর এই ব্যান্ডউইথ বিক্রি করে দেয় অন্য কোম্পানির কাছে। ইজরাইলের একটি ভিপিএন কোম্পানি হোলা ভিপিএন থেকে এরকম সম্প্রতি ঘটেছে।
৪। ব্রাউজার হাইজ্যাকিং : অনেক সময় আমরা যখন কোনো সাইটে ব্রাউজ করি, ক্লিক করলেই অন্য পেজ চলে আসে, আর অনেক ব্যক্তিগত তথ্য চেয়ে বসে। এটা অনেক সময় ভিপিএন এর মাধ্যমে হয়ে থাকে, আর তোমার তথ্য কালেক্ট করে। আমাদের উচিত এ-সব পেজে কোনো তথ্য না দেওয়া।
ভিপিএন আমরা যে কারণে ব্যবহার করবো ঠিক সে কারণেই কোনো ফ্রি ভিপিএন ব্যবহার করা ঠিক হবে না। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকেই যায়। আমাদের অনলাইন ব্যবহার হোক নিরাপদ। আজ তবে এই পর্যন্তই। তোমাদের সুস্থতা ও নিরাপত্তা কামনা করছি।
মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১
No Comment